স্বপন কান্তি সেন ২০১৫ সালের ডিসেম্বরে মারা যান। কিন্তু সেই স্বপন কান্তি সেনের সঙ্গেই চট্টগ্রাম মেডিক্যাল কলেজ (চমেক) হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ ‘ন্যায্যমূল্যের ওষুধের দোকান’ দুটির ভাড়ার চুক্তি করে আসছে বছরের পর বছর।
আগে হাসপাতালের প্রধান ভবনের মূল ফটকের নিচতলায় একটি ‘ন্যায্যমূল্যের ওষুধের দোকান’ ছিল। ২০২১ সালে হাসপাতালের জরুরি বিভাগের লাগোয়া আরও একটি ‘ন্যায্যমূল্যের ওষুধের দোকান’ খুলে সেটিও মৃত স্বপন সেনকেই বরাদ্দ দেয় হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ। এ ক্ষেত্রে উন্মুক্ত দরপত্রসহ সরকারি ক্রয়বিধির কোনো নিয়মই অনুসরণ করা হয়নি।
চমেক হাসপাতালের দেয়ালে-দেয়ালে লেখা আছে ‘ন্যায্যমূল্যের ওষুধের দোকান’ থেকে ওষুধ কিনুন। এভাবে সরকারি হাসপাতালের দেয়াল লিখনের কারণে রোগীরা এটা ভেবে নেন যে, ওষুধের দোকান দুটি সরকারি। ফলে সেখানে সর্বদা রোগীর স্বজনদের ভিড় লেগেই থাকে। নিয়ম আছে প্যাকেটের গায়ের দামের চেয়ে ১৫ শতাংশ কমে এসব ওষুধ বিক্রি করতে হবে। কিন্তু ওষুধ কেনার পর কম্পিউটার রসিদ দেওয়া হয় না। ক্রেতারা রসিদ চাইলে হাতে লিখে দেওয়া হয়। ফলে রোগী জানতে পারে না তিনি আসলেই কম দামে সেই ওষুধ পেলেন কিনা। অভিযোগ আছে, হাতে টাকার রসিদ লেখার মাধ্যমে কৌশলে রোগীদের প্রয়োজনের চেয়ে অতিরিক্ত ওষুধ দেওয়া হয়। অস্ত্রোপচার শেষে অবশিষ্ট ওষুধ বিভিন্ন মাধ্যমে হাতবদল হয়ে পুনরায় কথিত ন্যায্যমূল্যের দোকানেই ফিরে আসে। স্বয়ং চমেক হাসপাতালের পরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মো. শামীম আহসান ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, আমি কিছুতেই বুঝতে পারছি না, আমরা কেন ওই ওষুধ বিক্রির অংশ হয়ে গেলাম।
মৃত স্বপন সেনের ছেলে সঞ্জয় সেন বর্তমানে ‘ন্যায্যমূল্যের ওষুধের দোকান’ দুটি দেখভাল করছেন। তিনি আমাদের সময়কে বলেন, প্রথম দোকানটির ভাড়া হিসেবে চমেক হাসপাতাল কর্তৃপক্ষকে মাসিক পরিশোধ করেন ৯৬ হাজার টাকা। আর নতুন দোকানের জন্য পরিশোধ করেন ৯০ হাজার টাকা। জানা গেছে, বিগত বছরগুলোতে একাধিক ওষুধ ব্যবসায়ী দোকান দুটি নিতে আগ্রহ দেখিয়েছেন। তারা প্রতি দোকানের জন্য মাসে ২০ লাখ টাকা পর্যন্ত পরিশোধ করতে আগ্রহ দেখান। কিন্তু হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ তাতে রাজি হয়নি। এতে সরকার বিপুল পরিমাণ রাজস্ব হারায়। বাংলাদেশ মেডিক্যাল অ্যাসোসিয়েশনের (বিএমএ) চট্টগ্রাম শাখার একজন প্রভাবশালী নেতাও এই দোকান দুটি সঞ্জয় সেনের হাতে রাখার ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখে চলেছেন বলে জানা গেছে। অভিযোগ রয়েছে, ‘ন্যায্যমূল্যের ওষুধের দোকান’ দুটি নিজের নিয়ন্ত্রণে রাখতে হাসপাতালের কর্তাব্যক্তিদের হাতে প্রতি মাসে তুলে দিতে হয় বিপুল পরিমাণ নগদ অর্থ। বিএমএ নেতারাও পান অর্থের ভাগ।
সঞ্জয় কান্তি সেন আমাদের সময়কে বলেন, ২০০৪ সালে আমরা প্রথমবারের মতো কোটেশনের মাধ্যমে ন্যায্যমূল্যের ওষুধের দোকানটির বরাদ্দ পাই। সেই থেকে প্রতিবছর ৫ শতাংশ হারে বাড়তি ভাড়া পরিশোধ করছি। কিন্তু ২০১৪ সালের সর্বশেষ চুক্তিতে মাসিক ভাড়া ৯৬ হাজার ৯০৪ টাকা এবং অদ্যাবধি একই পরিমাণ টাকাই পরিশোধ করছেন। বিষয়টি জানতে চাইলে তিনি এ ব্যাপারে কোনো সদুত্তর দিতে পারেননি।
সরকারি ক্রয়বিধি (পিপিআর) অনুযায়ী, সরকারি জায়গায় ব্যবসা করতে হলে প্রতিবছরই উম্মুক্ত দরপত্রের (ওটিএম) মাধ্যমে ওই জায়গা বা দোকান বরাদ্দ নিতে হয়। এ ক্ষেত্রে সর্বোচ্চ দরদাতাই পাবেন বরাদ্দ। কিন্তু চমেক হাসপাতালের ‘ন্যায্যমূল্যের ওষুধের দোকান’ ২০০৪ সালে কোনো ধরনের নিয়মনীতি ছাড়াই বরাদ্দ পেয়ে আসছেন স্বপন সেন। মৃত্যুর পরও তার বরাদ্দপ্রাপ্তি অব্যাহত রয়েছে। শুধু তা-ই নয়, হাসপাতালের জরুরি বিভাগের সামনে ২০২১ সালে নির্মাণ করা হয় আরও একটি ‘ন্যায্যমূল্যের ওষুধের দোকান’। এ ক্ষেত্রেও সরকারি নিয়ম অনুসরণ না করে একই ব্যক্তিকে দেওয়া হয়। অথচ পিপিআর অনুযায়ী নিয়ম হলো উন্মুক্ত দরপত্রের মাধ্যমে এসব অবকাঠামো নির্মাণ ও বরাদ্দ দেওয়া।
২০১৪ সালে চমেক হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ ও স্বপন কান্তি সেনের মধ্যে সম্পাদিত সর্বশেষ চুক্তির ১ নম্বর শর্তে উল্লেখ আছে- ১ জুলাই ২০১৪ হতে ৩০ জুন ২০১৫ পর্যন্ত চুক্তিটি বলবৎ থাকবে। ২০১৫ সালের ডিসেম্বরে স্বপন কান্তি সেন মারা যান। কিন্তু এরপর থেকে অদ্যাবধি স্বপন কান্তি সেনের সঙ্গে নিয়মিত ব্যবসা চালিয়ে আসছে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ।
২০১৪ সালের ওই চুক্তিতে চমেক হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের পক্ষে স্বাক্ষর করেন হাসপাতালের পরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল খোন্দকার শহীদুল গনি। আর সাক্ষী হিসেবে ছিলেন চমেক হাসপাতালের হিসাবরক্ষণ কর্মকর্তা মো. শাহজাহান ও ফার্মাসিস্ট মো. হেলাল উদ্দিন।
এ প্রসঙ্গে চমেক হাসপাতালের সমাজকল্যাণ কর্মকর্তা ও ভারপ্রাপ্ত প্রশাসনিক কর্মকর্তা মো. নজরুল ইসলাম আমাদের সময়কে বলেন, হাসপাতালের যে কোনো দরপত্র দেওয়ার দায়িত্ব হলো হিসাবরক্ষণ কর্মকর্তা ও ফার্মাসিস্টের।
চমেক হাসপাতালের হিসাবরক্ষণ কর্মকর্তা মো. শাহজাহান বলেন, দরপত্রের কাজ আমি নই, প্রশাসনিক কর্মকর্তা নজরুল সাহেব দেখেন। আপনি নজরুল কিংবা পরিচালকের সঙ্গে কথা বলুন।
ফার্মাসিস্ট হেলাল উদ্দিন বলেন, আমি ‘ন্যায্যমূল্যের ওষুধের দোকান’ তদারকি কমিটির একজন সদস্য মাত্র। ২০১৪ সালের চুক্তির সময় পরিচালকের নির্দেশেই সাক্ষী হিসেবে চুক্তিপত্রে স্বাক্ষর করি।
স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় কর্তৃক প্রণীত মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের কার্যপরিধি অনুযায়ী হিসাবরক্ষণ কর্মকর্তার মূল দায়িত্ব হলো-বিভিন্ন ক্রয়, টেন্ডার ও নির্বাচন কমিটির কার্যক্রমে সহায়তা প্রদান করা।
চমেক হাসপাতালের পরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মো. শামীম আহসান আমাদের সময়কে বলেন, আসলে সরকারিভাবেই আমাদের বলা হয়েছে আমরা কাউকে দোকান বরাদ্দ দিতে পারব না। তাই দোকান দুটি নিয়ে আমরা কোনো সিদ্ধান্তে আসতে পারছি না। তবে তাদের আমরা চিঠি দেব তারা যেন আর ব্যবসা না করে চলে যান। এমন পরিকল্পনা থাকলে কেন এক বছর আগে আরও একটি দোকান বানিয়ে তাদের দেওয়া হলো? এমন প্রশ্নের জবাবে পরিচালক বলেন, আমরা তো যে কোনো সময় বরাদ্দ বাতিল করতে পারি, চুক্তিতে উল্লেখ আছে।