পত্রিকার পাতায় ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের সহযোগী সংগঠন ছাত্রলীগকে নিয়ে নানা রকম খবর যেন গা-সওয়া হয়ে গেছে। তারপরও এমন সব অপরাধ-অপকর্মের সঙ্গে ছাত্রলীগের নাম জড়িয়ে যায়, তা অকল্পনীয় মনে হয়। চাঁদাবাজি, টেন্ডারবাজি, দখল, অপহরণ, ধর্ষণ, খুনের মতো অপরাধ তো ছিলই; শেষ পর্যন্ত গরু চুরির সঙ্গেও জড়িয়েছে ছাত্রলীগের নাম।
ঢাকার ধামরাইয়ে গরুচোর চক্রের নেতৃত্ব দানকারী এক ছাত্রলীগ নেত্রীসহ পাঁচজনকে গ্রেপ্তার করেছে পুলিশ। গরুচোর চক্রটি গরু চুরি করে এনে বাবলী আক্তার নামে ওই ছাত্রলীগ নেত্রীর হেফাজতে রাখত। সেখান থেকেই চোরাই গরুগুলো পরে বিক্রি করা হতো। বাবলী ঢাকা উত্তর জেলা ছাত্রলীগের ছাত্রীবিষয়ক সম্পাদক। গ্রেপ্তার হওয়ার পর তাকে ওই পদ থেকে অব্যাহতি দিয়েছে জেলা ছাত্রলীগ এবং বহিস্কারের সুপারিশ পাঠিয়েছে কেন্দ্রীয় সংসদে।
সন্দেহ নেই- হত্যা, ধর্ষণ, অপহরণের তুলনায় গরু চুরি ‘নিরীহ’ অপরাধ। কিন্তু এই অপরাধের মধ্য দিয়ে ‘সাংস্কৃতিক মান’ বোঝাও সহজ হয়। লোকমুখে শুনেছি, কারাগারে সাজাপ্রাপ্তদের মধ্যেও গরুচোর সবচেয়ে ব্রাত্য। সেখানে একজন ছাত্রনেত্রী সংগঠনের আদর্শে অন্যদের অনুপ্রাণিত করার বদলে গরুচোর চক্রের নেতৃত্ব দিচ্ছেন!
এই তো ক’দিন আগে রাজধানীর ঐতিহ্যবাহী শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ইডেন কলেজে ছাত্রলীগ নেত্রীদের অপকর্মের খবর দেশব্যাপী আলোড়ন তুলেছিল। কয়েকজন ছাত্রলীগ নেত্রীর বিরুদ্ধে অভিযোগ উঠেছিল নীরিহ ছাত্রীদের অসামাজিক কাজে বাধ্য করার। কিন্তু সেসব অভিযোগের তদন্ত হয়নি। এক রকম ধামাচাপা পড়ে গেছে ঘটনাটি। অনেকেই মনে করেন, অপরাধীর বিরুদ্ধে কার্যকর ব্যবস্থা না নেওয়ার ফলেই তা ভাইরাসের মতো ছড়িয়ে পড়ছে ক্রমেই।
মাসখানেক আগে একই দিনের পত্রিকায় ছাত্রলীগের কীর্তিমানদের দুটি খবর প্রকাশিত হয়েছে। একটি এসেছে কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে। কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগের কমিটি বিলুপ্তিকে কেন্দ্র করে দুই পক্ষের সশস্ত্র মহড়ার পর কর্তৃপক্ষ অনির্দিষ্টকালের জন্য সব হল বন্ধ এবং সাত দিনের সব পরীক্ষা স্থগিত ঘোষণা করে। শিক্ষার্থীদের অবিলম্বে হল ত্যাগের নির্দেশ দেওয়া হয়। দ্বিতীয় খবরের উৎস ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়। খবরের ‘নায়ক’ বিশ্ববিদ্যালয়ের এস্টেট অফিসের তৃতীয় শ্রেণির কর্মচারী আমানুল্লাহ আমান। তিনি ছাত্রলীগের গ্রন্থনা ও প্রকাশনাবিষয়ক সম্পাদক। ছাত্রত্ব চুকেবুকে গেছে সেই কবে! কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয়ের শহীদ সার্জেন্ট জহুরুল হক হলের ২৬৪ নম্বর কক্ষই তাঁর আবাসস্থল। অফিসে দায়িত্ব পালন করেন খণ্ডকালীন। মানে মাঝেমধ্যে দর্শন দেন। তবে দলের কর্মকাণ্ডে দায়িত্ব পালন করছেন পূর্ণকালীন। খবরে তাঁকে ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় সভাপতি আল নাহিয়ান খান জয়ের ঘনিষ্ঠজন হিসেবে উল্লেখ করে বলা হয়েছে, সভাপতির সঙ্গে কর্মসূচিতে যোগ দিতে কখনও তিনি উড়াল দেন উড়োজাহাজে; কখনও দামি গাড়িতে রাস্তা কাঁপান। বোঝাই যাচ্ছে, সংগঠনের সভাপতির কাছের মানুষ হিসেবে আমান চাকরিবিধিকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে রাজনীতি করছেন এবং বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন ভঙ্গ করে হলের কক্ষ দখলে রাখতে সমর্থ হচ্ছেন।
কেন এই অধঃপতন? তাহলে কি ছাত্র সংগঠনে এখন আর আদর্শের চর্চা হয় না? মনে পড়ে, স্বাধীনতা-পরবর্তী সময়ে আমরা যখন ছাত্র রাজনীতিতে সম্পৃক্ত হই, তখন আমাদের প্রথমেই বলা হতো, আদর্শ মানুষ হতে হবে। আদর্শ মানুষ ছাড়া আদর্শ রাজনীতিক হওয়া যায় না। সে সময় প্রায় সব ছাত্র সংগঠনেই আদর্শের চর্চা হতো। নেতারা কর্মীদের ভালো কাজে উদ্বুদ্ধ করতেন। কর্মীরাও নেতাদের নির্দেশনায় সাংগঠনিক কাজের পাশাপাশি সমাজসেবামূলক কাজে নিবেদিত হতেন। তখন কোনো ছাত্র সংগঠনের নেতাকর্মীর বিরুদ্ধে টেন্ডারবাজি, চাঁদাবাজি, অপহরণ, খুন, ধর্ষণের মতো জঘন্য অপরাধে সম্পৃক্ত হওয়ার খবর পাওয়া যেত না।
পাকিস্তান আমলের শেষভাগে আমরা যখন স্কুল-বালক, তখন দেশে দুটি ছাত্র সংগঠন ছিল সর্বব্যাপী। ছাত্রলীগ ও ছাত্র ইউনিয়ন। ছাত্র ইউনিয়ন অবশ্য দুই ভাগে বিভক্ত ছিল- মেনন গ্রুপ ও মতিয়া গ্রুপ। আমরা তখন দেখেছি, ছাত্রনেতাদের মানুষ কতটা সম্মানের চোখে দেখত; সমীহ করত! কেউ বিপদে পড়লে কিংবা কারও দ্বারা অত্যাচারিত হলে ছাত্রনেতাদের কাছে সাহায্য চাইত। তাদের আস্থা ও বিশ্বাস ছিল, চেয়ারম্যান-মেম্বার-মাতবররা অবিচার করতে পারেন। কিন্তু ছাত্রনেতারা কারও প্রতি অবিচার করবেন না। সমাজে এই শ্রদ্ধার আসনে ছাত্রনেতারা অধিষ্ঠিত হয়েছিলেন তাঁদের আদর্শবাদিতা ও সততার কারণে। কিন্তু আজ সময়ের সঙ্গে সঙ্গে সব যেন কেমন ওলটপালট হয়ে যাচ্ছে। সর্বত্র নেমেছে ধস। নৈতিক মূল্যবোধের যে অবক্ষয় সমাজের নানা স্তরে বাসা বেঁধেছে; ছাত্র রাজনীতিও তার বাইরে থাকতে পারেনি। আর তাই এক সময়ের আশা-ভরসাস্থল ছাত্রনেতারা এখন কোথাও কোথাও মূর্তিমান আতঙ্ক। অন্যায়ের প্রতিবাদ-প্রতিরোধ তো দূরের কথা, তাঁরা নিজেরাই নিমজ্জিত অনৈতিকতার পচা ডোবায়। ছাত্রলীগের সাম্প্রতিক কার্যকলাপ যে আওয়ামী লীগ তথা সরকারের নীতিনির্ধারকদেরও শিরঃপীড়ার কারণ হয়ে উঠেছে, তা ঊর্ধ্বতন নেতাদের কথাবার্তায় মাঝেমধ্যে বোঝা যায়। দলের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের ক’দিন আগেও ছাত্রলীগ কর্মীদের সতর্ক করে দিয়েছিলেন সংঘাতে না জড়াতে। কিন্তু সেসব সতর্কবার্তায় ছাত্রলীগের ওইসব ‘অকুতোভয় সৈনিক’ এতটুকু দমে গেছেন বলে মনে হয় না।
অনেকেরই স্মরণ থাকার কথা, ছাত্রলীগের এহেন কাজকর্মে ত্যক্ত-বিরক্ত হয়ে প্রধানমন্ত্রী ও আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনা একবার সংগঠনটির সাংগঠনিক নেত্রীর পদ থেকে সরে যাওয়ার ঘোষণা দিয়েছিলেন। সেবার নেতারা ‘আর হবে না’- এ ধরনের কথা বলে তাঁকে নিবৃত্ত করেছিলেন। কিন্তু তাঁরা কথা রাখেননি। সে জন্য প্রায়ই সংবাদমাধ্যমে নেতিবাচক খবরের শিরোনাম হচ্ছে ছাত্রলীগ।
কয়েক দিন আগে মতিঝিলের একটি অফিসে বসে কথা হচ্ছিল এসব নিয়ে। উপস্থিত সবাই একসময় ছাত্রলীগের সঙ্গে সম্পৃক্ত ছিলেন, একমাত্র আমি ছাড়া। বর্তমানে তাঁরা সমাজের নানা স্তরে অবস্থান করলেও মতাদর্শের দিক দিয়ে আগের অবস্থানেই। তাঁদের মধ্যে একজন বীর মুক্তিযোদ্ধা; ছাত্রলীগের থানা কমিটির সভাপতি ছিলেন। স্থানীয় কলেজ ছাত্র সংসদের ভিপি ছিলেন দুইবার। মনেপ্রাণে এখনও বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের আদর্শকে বুকে ধারণ করেন তিনি। আমরা যাঁরা বিপরীত মেরুর রাজনীতির সঙ্গে সম্পৃক্ত ছিলাম, তাঁরাও তাঁকে শ্রদ্ধা করি তাঁর সততা, উদারতা এবং পরমতসহিষুষ্ণতার জন্য। আলোচনাকালে তিনি ক্ষোভ ঝাড়লেন এই বলে- ‘ছাত্রলীগ যা করছে; দেখে দুঃখে কলিজা ফেটে যায়। এই কি বঙ্গবন্ধুর আদর্শের পতাকাধারী ছাত্রলীগ?’
মহিউদ্দিন খান মোহন: সাংবাদিক ও রাজনীতি বিশ্নেষক