তুরস্ক থেকে কেনা ড্রোন যুদ্ধ ক্ষেত্রে বড় সাফল্য এনে দিয়েছে আজারবাইজানকে।মানব বিহীন অত্যাধুনিক সামরিক ড্রোন হামলায় টিকতে না পেরে পিছু হটছে আরমেনিয়া।ইতিমধ্যে আর্মেনিয়ান বাহীনি থেকে কৌশলগত গুরুত্বপূর্ন কয়েকটি পাহাড়ের নিয়ন্ত্রণ নিয়েছে আজাইবাইজান সৈন্যরা।রাডার এবং আধুনিকেয়ার ডিফেন্স ফাঁকি দিতে সক্ষম এসব ড্রোন অত্যন্ত নিখুঁতভাবে টার্গেটকে লক্ষ করে হামলা চালাতে পারে। সিরিয়ায় আসাদ বাহিনী এবং লিবিয়ায় হাফতার বাহীনির পরাজয়ের মূলে ছিল তুরস্কের এই অত্যাধিনিক ড্রোন।
যুদ্ধে পরাজয়ের লক্ষন টের পেয়ে ইতিমধ্যে সুর নরম করেছেন আরেমেনিয়ার প্রধানমন্ত্রী।তিনি শান্তি আলোচনার প্রস্তাব দিয়েছেন।তবে নিজেদের এলাকাকে দখলদার বাহিনী থেকে সম্পুর্নরুপে স্বাধীন করার প্রত্যয় ব্যক্ত করে লড়াই চালিয়ে যাচ্ছে আজারবাইজান সৈন্যরা।আর সন্দেহ নেই এতে পিছনের কলকার কাঠি নাড়ছে আজারবাইজানের সবচেয়ে ঘনিষ্ঠ মিত্র তুরস্ক।গোপন না রেখে ইতিমধ্যে প্রকাশ্যে আজার বাইজানকে সব ধরনের সহায়তা দেওয়ার ঘোষণা দিয়েছেন এরদোয়ান।ইতিমধ্যে তিনি ৪ হাজার সেনা পাঠিয়েছেন।তুরসকের সামরিক বিশেষজ্ঞরা প্রযুক্তিগত সহায়তা দিয়ে চলেছেন।
ড্রোন ফোর্সে নতুন পরাশক্তি তুরস্ক
সর্বাধুনিক প্রযুক্তির কোনো যুদ্ধবিমান এখন পর্যন্ত তৈরি করেনি তুরস্ক। তবে কাছাকাছি ধরনের এক যুদ্ধ সরঞ্জাম তৈরি করছে তারা। এটি হলো- ড্রোন। ইতোমধ্যে বিশ্বজুড়ে সাড়া ফেলেছে তুরস্কের তৈরি এসব ড্রোন।
মার্কিন ম্যাগাজিন দ্য ন্যাশনাল ইন্টারেস্ট জানায়, সম্পূর্ণ আলাদা ধরনের যুদ্ধবিমান তৈরি করছে তুরস্ক। তারা এগুলোর ব্যবহারকারী ও বিক্রেতা। নিজস্ব প্রযুক্তিতে তৈরি তুরস্কের এসব ড্রোন এরই মধ্যে বিশ্বজুড়ে ব্যাপক সাড়া ফেলেছে।
তুরস্কের কয়েক ধরনের ড্রোন রয়েছে। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য একটি হলো- আঙ্কা-এস। ২০১৩ সালে এটি তৈরির কাজ শুরু হয়। এরপর ২০১৬ সালে প্রথমবারের মতো এই ড্রোন ব্যবহার করে তুরস্ক।
আঙ্কা-এস নামের ড্রোনটি ২৬ ফুট লম্বা। এটি ৪০০ পাউন্ড পর্যন্ত অস্ত্র বহন করতে পারে। এটি ২৪ ঘণ্টারও বেশি সময় একটানা আকাশে উড়তে সক্ষম এবং এটি দিয়ে ক্ষেপণাস্ত্রও ছোড়া যায়। সবমিলিয়ে যুদ্ধক্ষেত্রে বাড়তি সুবিধা আদায় করতে সক্ষম এই ড্রোন।
হিসাব বলছে, বর্তমানে তুর্কি সামরিকবাহিনীর কাছে বিভিন্ন মডেলের ১৩০টিরও বেশি ড্রোন রয়েছে। বিশাল সংখ্যক এই ড্রোনের সমন্বয়ে শক্তিশালী এক ফোর্সে পরিণত হয়েছে তুরস্ক। এরই মধ্যে আঙ্কারা তাদের ড্রোন ফোর্সের ক্ষমতাও দেখিয়েছে। সিরিয়া অভিযানে তুর্কি ড্রোন ফোর্সের হামলার মুখে পিছু হটেছে শক্তিশালী রাশিয়াও।
নিজস্ব প্রযুক্তিতে তৈরি তুর্কি এই ড্রোন ফোর্স দেখে বিশ্লেষকরা বলছেন, বর্তমানে বিশ্বের অন্যতম শক্তিশালী ড্রোন ফোর্স রয়েছে তুরস্কের। তাদের এই ফোর্স যে কোনো সময় যুদ্ধ পরিস্থিতি পাল্টে দিতে পারে। ড্রোন ক্ষমতায় শীর্ষে থাকার কারণে অনেক দেশই এখন আঙ্কারাকে সমীহ করে চলবে।এ দিকে তুর্কি ড্রোনের কার্যকারিতায় মুগ্ধ হয়ে দেশটি থেকে ড্রোন কেনার সিদ্ধান্ত নিয়েছে তিউনিসিয়া। তারা এরই মধ্যে ২৪০ মিলিয়ন ডলারের চুক্তিও করেছে। চুক্তির আওতায় ৬টি ড্রোন ও প্রয়োজনীয় অন্যান্য প্রযুক্তিগত সরঞ্জাম পাবে তিউনিসিয়া।
যেভাবে তুরস্কের ড্রোন বিপ্লবের সূত্রপাত
তুরস্ক দীর্ঘদিন ধরে কুর্দিস্তান ওয়ার্কাস পার্টি বা পিকেকে’র বিরুদ্ধে অভিযান পরিচালনা করে আসছে। সেসব অভিযানের অধিকাংশই ছিল প্রায় বিচ্ছিন্ন পার্বত্য অঞ্চলে। সেখানে বিদ্রোহীদের বেশ প্রভাব ছিল। ফলে তুরস্ক সেখানে খুব বেশি সুবিধা করতে পারছিল না।
তুরস্ক তখন ড্রোনের কথা ভাবতে শুরু করে। ইতোমধ্যে তারা পাকিস্তানে বিভিন্ন যোদ্ধাদের বিরুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্রের ড্রোন হামলার সাফল্য দেখেছে। তুর্কি সেনাবাহিনী একইভাবে কুর্দিদের বিরুদ্ধে ড্রোন হামলার কথা বিবেচনা করছিল। কিন্তু তাদের কাছে উপযুক্ত ড্রোন ছিল না।
এক্ষেত্রে তুরস্কের ভরসা ছিল মিত্র যুক্তরাষ্ট্র। কিন্তু যুক্তরাষ্ট্র তুরস্কের কাছে তাদের ড্রোন প্রযুক্তি শেয়ার কিংবা বিক্রি করতে সংকোচবোধ করছিল। এর বদলে তারা তুরস্ককে অস্ত্রবিহীন কিছু মৌলিক ড্রোন বিক্রি করার প্রস্তাব দেয়। তখন তাদের প্রস্তাব নাকচ করে দিয়ে তুরস্ক অন্য উপায় বের করার সিদ্ধান্ত নেয়।
সেসময় ইজরায়েল তাদের ড্রোন শিল্পকে বিস্তৃত করছিল। তুরস্কের কাছে ইজরায়েল ছিল প্রাথমিক পছন্দ। তাদের কাছে থেকে অল্প কিছু হেরন ইউএভি ক্রয় করে। কিন্তু এই ড্রোনগুলো সরবরাহ করতে ইজরায়েল অনেক দেরি করে। ফলে এখানেও তুরস্কের তিক্ত অভিজ্ঞতা হয়। তখন তুরস্ক অনুধাবন করতে পারে প্রযুক্তি ও গোয়েন্দাগিরি নিয়ন্ত্রণ ধরে রাখতে হলে নিজেদেরই ড্রোন তৈরি করতে হবে।
ঠিক তখন দৃশ্যপটে হাজির হন সেলজুক বায়রাকতার, যিনি প্রেসিডেন্ট এরদোয়ানের জামাতা। তাকে তুরস্কে ড্রোন শিল্পের দাদা হিসেবে গণ্য করা হয়। বায়রাকতার তখন পেনসিলভেনিয়া বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতকোত্তর শেষ করেছেন। ২০০৪ সালে তিনি যৌথভাবে একটি পেপার লেখেন। সেখানে তিনি একসাথে একাধিক ড্রোন নিয়ন্ত্রণ ও পরিচালনার উপায় তুলে ধরেন।
এরপর বায়রাকতার তার পিএইচডি গবেষণা ছেড়ে তুরস্ক চলে আসেন। দেশে ফিরে তিনি ‘বায়কার টেকনোলজিস’ নামে একটি কোম্পানি চালু করেন। তিনি তার কোম্পানি থেকে তুরস্কের সেনাবাহিনীর জন্য ড্রোন নির্মাণ শুরু করেন। শুরুতে বায়কার টেকনোলজিস লোকসানের মুখোমুখি হয়। কিন্তু পরে তিনি সরকারের সহায়তায় ঘুরে দাঁড়ান।
তুরস্ক সরকার তাদের ইউএভি প্রোগ্রামের উন্নতি করার চেষ্টা করছিল। কারণ যুক্তরাষ্ট্র তাদের কাছে ড্রোন বিক্রি করছিল এবং কুর্দিদের বিরুদ্ধে অভিযান চালাতে কিছু সংকটের মুখোমুখি হয় তুর্কি সেনারা। ফলে তাদের শক্তিশালী ড্রোনের প্রয়োজন ছিল, যা বায়রাকতারকে সুযোগ করে দেয়।
বায়রাকতার টিবি-টু ইউএভি তৈরি করে করে সেলজুকের কোম্পানি। ১৫০ কিলোমিটার রেঞ্জের ড্রোনটি তুর্কি সেনাবাহিনীর জন্য একেবারে উপযুক্ত ছিল। এরপর এই ড্রোনের মাধ্যমে তুরস্ক পিকেকে-এর ওপর হামলা চালিয়ে বেশ সাফল্যও পায়৷
পরবর্তীতে সিরিয়ার আফরিনে অভিযানের সময় তুরস্ক একইসাথে ইউএভি ও আর্টিলারির পরীক্ষা চালায়৷ তাদের এই ট্যাকটিস ইদলিবেও ব্যবহার করা হচ্ছে। এই যুদ্ধে তুরস্ক শুধু বায়রাকতার টিবি-টু ব্যবহার করছে করছে না। পাশাপাশি নতুন ও উন্নত আনম্যানড কমব্যাট এরিয়াল ভেহিকালস (ইউসিএভি) ব্যবহার করছে। এছাড়া ইদলিবে প্রথমবারের মতো আরো শক্তিশালী, অস্ত্রযুক্ত ও স্যাটেলাইটের সাথে লিঙ্ক করা আঙ্কা-এস ড্রোনও ব্যবহার করা হয়েছে। তুরস্ক তাদের ড্রোনগুলো বিভিন্নভাবে ব্যবহার করছে।
লাভজনক ব্যবসা
প্রেসিডেন্ট এরদোয়ান প্রতিরক্ষা শিল্পের নিয়ন্ত্রণ নেওয়ার পর থেকে তুরস্ক এক উচ্চবিলাসী স্বপ্নের পথে হাঁটছে। তারা একইসাথে বিশ্বের শীর্ষ ক্ষমতাধর রাষ্ট্র ও অস্ত্র বিক্রেতার তালিকায় যাওয়ার চেষ্টা করছে। এরদোয়ান ২০২৩ সালের মধ্যে শীর্ষ দশ অস্ত্র বিক্রেতার মধ্যে তুরস্ককে নিয়ে যেতে চান। এক্ষেত্রে তাদের ইদলিব অভিযান বড় ভূমিকা পালন করতে পারে।
তুরস্ক ইতোমধ্যে ইউক্রেনে ১২টি এবং কাতারে ৬টি টিবি-টু ড্রোন বিক্রি করেছে। তিউনিসিয়ার কাছে তুরস্ক নিজস্ব ড্রোন বিক্রির একটি চুক্তি করতে যাচ্ছে। এছাড়া ইন্দোনেশিয়া, পাকিস্তান ও ইউক্রেন তুরস্কের প্রযুক্তিতে ড্রোন তৈরির কাজ করছে। বর্তমানে ড্রোন উৎপাদনে ইজরায়েলকে ছাপিয়ে চীনের কাছাকাছি চলে গেছে তুর্কিরা। তাদের কিছু ড্রোন আবার যুক্তরাষ্ট্রের সমমানের। এমন কিছু ইউসিএভি রয়েছে তাদের, যা রাশিয়ার কাছেও নেই!
তুরস্কের ড্রোন ব্যবসা ভবিষ্যতে আরো বিস্তৃত হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। কেননা ইদলিবে তারা নিজেদের ড্রোনের সফল ব্যবহার করেছে। যুদ্ধের ময়দানে যেসব অস্ত্র সফলতা অর্জন করে, সেসবের প্রতি সকলের বাড়তি আগ্রহ থাকে। তাই ভবিষ্যতে হয়তো তুরস্কের ড্রোন মধ্যপ্রাচ্যসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশের কাছে আকাঙ্ক্ষিত অস্ত্রেও পরিণত হবে।
এদিকে নিজস্ব প্রযুক্তিতে অস্ত্র তৈরির বিষয়টি তুরস্কের জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ। কেননা ন্যাটোর সাথে তুরস্কের সম্পর্ক খুব ভালো যাচ্ছে না। এ কারণে নিজেদের নিরাপত্তার জন্য তুরস্ক যে পদক্ষেপ নিচ্ছে এবং এগিয়ে যাচ্ছে, তা অনেক দেশের জন্য অনুকরণীয়।