ঈদের আগের দিন রাত। অন্য আট দশদিনের মতো হেফজখানার শিশুরা ছাদে গিয়েছিল গল্প করতে। গল্পও চলছিল বেশ। কিন্তু কিছুক্ষণ পরেই তারা শুনতে পায় গুলির শব্দ। ওই ছাদ থেকে অল্প দূরত্বে বাহারছড়া এপিবিএন-এর চেকপোস্ট। যেখানে অবসরপ্রাপ্ত সেনা কর্মকর্তা মেজর সিনহা মোহাম্মদ রাশেদ খানকে গুলি করে হ’ত্যা করা হয়। এই দৃশ্য পুরোটা দেখেছে রাহামানিয়া তাফিমুল কোরআন মাদ্রাসা ও এতিমখানার দশ শিশু। এই দৃশ্য দেখে হাউমাউ করে কাঁদতে কাঁদতে ছাদ থেকে নেমে যায় তারা। এর পর থেকেই প্রত্যক্ষদর্শী শিশুরা দুঃসহ স্মৃতি বয়ে বেড়াচ্ছে। ঘটনার ১৮ দিন পরেও সেই স্মৃতি ভেসে আসছে তাদের চোখের সামনে। মাঝে মাঝে কেউ কেউ ঘুম থেকে আঁতকে ওঠছে।
মাদ্রাসা সংশ্লিষ্টরা বলছেন, ঈদে ছুটি কাটিয়ে গত কয়েকদিন আগে শিশুরা মাদ্রাসায় আবার ফিরলেও তাদের মধ্যে আতঙ্ক কমেনি এতোটুকু। শুধু তাই নয়, এসব শিশুদের প্রতিনিয়ত বিভিন্ন গোয়েন্দা সংস্থা ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর লোকজন জিজ্ঞাসাবাদ করছে। ফলে তাদের মধ্যে সবসময় এক ধরনের আতঙ্ক কাজ করছে। ভয়ে কারো সঙ্গে কথা বলছে না। কেউ কথা বলতে চাইলে লুকিয়ে যাচ্ছে। এদিকে গত শনিবার প্রত্যক্ষদর্শীদের গণশুনানির দিন তাদেরকে নিয়ে আসা হয় সাক্ষ্য দেয়ার জন্য। সেই দিনও সকাল সাড়ে নয়টা থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত তাদের বসিয়ে রাখা হয়। কিন্তু কোনো ধরনের সাক্ষ্য নেয়া হয়নি। সরজমিন দেখা যায়, মাদ্রাসার সভাপতি নূরুল হক তাদেরকে শিঙ্গাড়া এনে দিয়েছে দুপুরে খাবার জন্য। ওইদিন এভাবে একটি শিঙ্গাড়া খেয়ে সারাদিন কেটেছে ওই শিশুদের। কথা হয় মাদ্রাসার সভাপতির সঙ্গে। তিনি বলেন, আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর লোকজন থেকে আমাদের বলা হয়েছিলো, তাদেরকে নিয়ে আসার জন্য। তাই নিয়ে আসছি। তাদের মানসিক অবস্থা কেমন জিজ্ঞেস করলে তিনি বলেন, ছোট বাচ্চাদের সামনে এতো বড় একটা ঘটনা ঘটেছে তাদের মানসিক অবস্থা কেমন তাতো বুঝতেই পারছেন।
তাদের মধ্যে যে প্রাণচাঞ্চল্য ছিল সেটা আর এখন নেই। মাঝে মধ্যে তারা এখনো কান্না করে। ঘটনার দিন কেউ ঘুমাতে পারেনি। সবাই কান্নাকাটি করছিলো। ভয়ে মাদ্রাসা থেকে কেউ বের হয়নি। শিশুরা এখানে আসতে ভয় পাচ্ছিল। তাই তাদের সঙ্গে আমি এসেছি। এদিকে বাহারছড়া ইউনিয়নের শামলাপুর রোহিঙ্গা ক্যাম্প ইনচার্জ কার্যালয়ে কথা হয় ওই দশ শিশুর সঙ্গে। তারা কি দেখেছিলো সেদিন? এমন প্রশ্ন করতেই অনেকের চোখে মুখে ভয়ের ছাপ। এই শিশুগুলোর মধ্যে সেফায়েত উল্লাহ বলে, আমরা সেইদিন এশার নামাজের একটু পরে ছাদে ওঠেছিলাম। ছাদ থেকে রাস্তা স্পষ্ট দেখা যায়। ওইদিন একজনকে গুলি করতে দেখেছিলাম পুলিশকে। এর আগে যাকে গুলি করেছে সে মাটিতে বসেছিলো হাত উপর করে। ওই শিশুদের মধ্যে আব্দুল আজিজ বলে, গুলির শব্দ তখন আমরা শুনছিলাম ও দেখছিলাম। আমাদের সবার কান্না চলে আসছে। আমরা খুব ভয় পেয়ে নিচে নেমে যাই। ওইদিন রাতে ঘুমাতে পারেনি খুব ভয় পাচ্ছিলাম। পরে হুজুররা এসে আমাদের পাশে ছিল। পরের দিন আমরা কয়েকজন ভয়ে বাড়ি চলে গিয়েছিলাম।ওই মাদ্রাসার শিক্ষক ও বায়তুল জামে মসজিদের ইমাম নিজেও একজন প্রত্যক্ষদর্শী হাফেজ শহিদুল ইসলাম। তিনি বলেন, এশার নামাজের পর কয়েকজন ছাত্র ছাদে গিয়েছিল। এর আধাঘণ্টা পর একটি গুলির শব্দ শুনতে পাই। তাছাড়া গুলির শব্দে ওরা কান্নাকাটি করছিলো। তখন আমি মনে করেছি ছাত্ররা দুষ্টামি করছে। তাই আমি ছাদে যাই। গিয়ে দেখি ছাত্ররা কান্নাকাটি করলেও ওরা ভয়ে নড়তে পারছে না।
পরে ছাদে ওঠার পর আমি দেখি একজন ভদ্রলোক দুই হাত উপরে তুলে মাটিতে বসে আছেন। এখান থেকে স্পষ্ট দেখা যাচ্ছিল। কারণ ওখানে আলো ছিল। কাজী হাফেজ শহিদুল ইসলাম বলেন, এই অবস্থায় এসআই লিয়াকত (অস্ত্র হাতে ছিল, পরে নাম জানতে পারি) কয়েক সেকেন্ডের মধ্যে তাকে তিনটি গুলি করেন। এরপরে ওই ব্যক্তি মাটিতে লুটিয়ে পড়েন। এরপর তাকে রাস্তার পূর্বপাড়ে রাখা হয়। এর বিশ মিনিট পর দুটি সাদা গাড়ি আসছিল। আধা ঘণ্টা পর স্থানীয় ভাষায় ছারপোকায় (লেগুনায়) করে তাকে নিয়ে যাওয়া হয়। আমি যা দেখেছি এর আগে থেকে শিশুরা গুলি করা পর্যন্ত তারা তা দেখেছিলো। আমি নিজেও খুব ভয় পেয়েছিলাম। বাচ্চাদের কথা কি বলবো। বাচ্চারা ওইদিন রাতে ঘুমাতে পারেনি। এখনো অনেকে ঘুমাতে পারছে না।