Breaking News

স্পেশাল ব্রাঞ্চের অতিরিক্ত ডিআইজির অবাক কান্ড

পারিবারিক বিরোধে প্রতিপক্ষকে ফাঁসাতে ইন্টারপোলে ভুয়া তথ্য দিয়ে রেড নোটিশ পাঠানোর ব্যবস্থা করেছেন শেখ রফিকুল ইসলাম। তিনি ঢাকায় সিটি এসবি’র (নগর স্পেশাল ব্রাঞ্চ) অতিরিক্ত ডিআইজি। চাঞ্চল্যকর এই বিষয়টি জানাজানির পর শীর্ষ পুলিশ কর্মকর্তাদের নির্দেশে রেড নোটিশ প্রত্যাহার করে পুলিশ সদর দপ্তরের ইন্টারপোল ডেস্ক। কিন্তু ভুক্তভোগীর ক্ষতি যা হওয়ার হয়ে গেছে। পুলিশের এই ভুল রিপোর্টের খেসারত দিতে হচ্ছে গোপালগঞ্জের সৌদি প্রবাসী হাবিবুর রহমান রাজ্জাককে। প্রায় দেড় বছর ধরে তিনি মক্কার কারাগারে বন্দি জীবন কাটাচ্ছেন।

ওই পুলিশ কর্মকর্তার ভাগনির বিবাহ বিচ্ছেদের পর ইন্টারপোলে হত্যা, অর্থ পাচার ও সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডে জড়িত থাকার ভুল অভিযোগ আনা হয় ভাগনি জামাই হাবিবুর রহমান রাজ্জাকের বিরুদ্ধে। ইন্টারপোলে এই রেড নোটিশ পাঠানোর পর জেদ্দায় গ্রেফতার হন তিনি।

ঊর্ধ্বতন পুলিশ কর্মকর্তারা বলেছেন, ইন্টারপোল হচ্ছে ইন্টারন্যাশনাল ক্রিমিনাল পুলিশ অরগানাইজেশন। আন্তর্জাতিক অপরাধ ও অপরাধীদের প্রতিরোধে ১৯২৩ সালে ফ্রান্সে এটি গঠিত হয়। অথচ আন্তর্জাতিক অপরাধীদের বিরুদ্ধে আইনি পদক্ষেপ নেওয়ার এই সংস্থাকে পারিবারিক বিরোধের জেরে ব্যক্তিস্বার্থে অপব্যবহার করেন পুলিশের এই পদস্থ কর্মকর্তা।

এদিকে তথ্যানুসন্ধানে পুলিশের এই পদস্থ কর্মকর্তার বিরুদ্ধে ক্ষমতার অপব্যবহারের আরও একটি চাঞ্চল্যকর তথ্য পাওয়া গেছে। তিনি পাবনার পুলিশ সুপার থাকাকালে হাবিবের আপন মামাকে মিথ্যা ধর্ষণ মামলা দিয়ে ফাঁসানোর অপচেষ্টা করেন। ধর্ষণের মতো গুরুতর অভিযোগে ২টি মিথ্যা মামলা দেওয়া হয়। মামলার বাদীরা এ বিষয়ে যুগান্তরের কাছে চাঞ্চল্যকর আরও তথ্য দিয়েছেন।

সরেজমিন সৌদি আরবের মক্কায় কথা হয় ভুক্তভোগী সৌদিপ্রবাসী হাবিবুর রহমানের আইনজীবী প্যানেলের এক সদস্যের সঙ্গে। তিনি প্রতিবেদকের সঙ্গে এক দোভাষীর সাহায্যে সরাসরি কথা বলেছেন। তিনি বলেন, ‘সৌদি আরবের স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের যোগাযোগ বিভাগের পরিচালকের পক্ষ থেকে ১৪৪২ হিজরি সনের ১২ সাবান সিআইডি পুলিশের কাছে টেলিগ্রাম (নং-১০৭৬৩৭৮) আসে। ইন্টারপোলের উদ্ধৃতি দিয়ে ওই টেলিগ্রামে বলা হয়, ‘অভিযুক্ত হাবিব বাংলাদেশে হত্যা, মানব পাচার, মানি লন্ডারিং ও সন্ত্রাসের অভিযোগে ওয়ান্টেড।’ ২০২১ সালের ২৬ জানুয়ারি ইন্টারপোলের রেড নোটিশ জারি করা হয় হাবিবের নামে। এরপরই তাকে জেদ্দা শহরের আজিজমলের পেছনে আল ফয়সালিয়া এলাকা থেকে হিজরি ১৪৪২ সনের ১৯ শাওয়াল (২৩ মে ২০২১) গ্রেফতার করে দেশটির সংশ্লিষ্ট পুলিশ টিম। ইন্টারপোল ঢাকার রেড নোটিশে বলা হয়, ‘বাংলাদেশে হত্যাসহ সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডের বিচারের জন্য তাকে প্রয়োজন। হাবিবুর রহমান হাবিব নাম পরিবর্তন করে রাজ্জাক নামে সৌদি আরবে অবস্থান করছেন।’ তাকে গ্রেফতার করে বাংলাদেশে পাঠানোর আহ্বান জানানো হয় ইন্টারপোলের নোটিশে।

এই রেড নোটিশের বিষয়ে যুগান্তরের পক্ষ থেকে পুলিশ সদর দপ্তরে ইন্টারপোল ডেস্কে যোগাযোগ করা হয়। তৎকালীন সময়ে সংশ্লিষ্ট ডেস্কে দায়িত্বরত একজন সিনিয়র পুলিশ কর্মকর্তা যুগান্তরকে বলেন, ‘সিটি এসবির অতিরিক্ত ডিআইজি শেখ রফিকুল ইসলাম ভুল বার্তা দিয়ে পারিবারিক বিরোধে ইন্টারপোলকে অপব্যবহার করেন। এই রেড নোটিশ ইন্টারপোলকে প্রশ্নবিদ্ধ করেছে। বিষয়টি জানতে পেরে ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের পরামর্শে সংশোধন করে পালটা ইলেকট্রনিক মেসেজ রিয়াদে পাঠানো হয়।’ পালটা ওই মেসেজের কোনো ডকুমেন্ট আছে কিনা জানতে চাইলে তিনি এ সংক্রান্ত মেসেজের অফিসিয়াল নথির ফটোকপি দেখান। সেখানে বলা আছে, ‘২০২১ সালের ২৯ সেপ্টেম্বর শেখ হাবিবুর রহমান ইবাদত, পাসপোর্ট নং বিসি০৪৯৪৭৫৪, রেড নোটিশ নং এ ২৭/১-২০২১। ৯ সেপ্টেম্বর মানব পাচার, সন্ত্রাসী কার্যক্রম ও অর্থ পাচারের বিষয়ে ইন্টারপোল রিয়াদে যে অভিযোগ পাঠানো হয় তার সঙ্গে হাবিবের জড়িত থাকার কোনো প্রমাণ পাওয়া যায়নি। তার আসল নাম রাজ্জাক, এই নামেই তিনি পাসপোর্ট নিয়েছেন। ডাক নাম হাবিবুর রহমান। এ বিষয়ে ঢাকার ইন্টারপোল দ্বিতীয়বার আরেকটি মেসেজ পাঠিয়ে অভিযোগটি বাতিল করে দেয়। এ তথ্য জানানো হয় রিয়াদেও। এমনকি বিষয়টি সম্পর্কে আর অগ্রসর না হতে রিয়াদকে অনুরোধ করা হয়।

তথ্যানুসন্ধানে দেখা গেছে, হাবিবের স্ত্রী অতিরিক্ত ডিআইজি শেখ রফিকুল ইসলামের ভাগনি তানজিলা হক উর্মি সর্বশেষ ২০১৬ সালে যে পাসপোর্টটি (বিকে০৭২১৩৬৮) নবায়ন করেন সেখানেও স্বামীর নাম লেখা আছে রাজ্জাক। এই পাসপোর্টে জরুরি প্রয়োজনে যোগাযোগের জন্য অতিরিক্ত ডিআইজি শেখ রফিকুল ইসলাম শিমুলের নামও রয়েছে। অর্থাৎ পাসপোর্ট করার সময় তিনি বিষয়টি জানতেন। তখন তিনি পুলিশ সদর দপ্তরের এআইজি। অথচ প্রকৃত নাম জানার পরও ইন্টারপোলে ভিন্ন নামে হাবিব সৌদি আরবে অবস্থান করছেন এমন তথ্য দিয়ে ভাগনি জমাইকে ফাঁসিয়ে দেন।

হাবিবকে গ্রেফতারের পর জেদ্দা পুলিশ তার সে দেশে বসবাসের বৈধতা পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে কোনো জাল-জালিয়াতির তথ্য পায়নি। তার প্রথম পাসপোর্ট ছিল হাবিবুর রহমান নামে আর দ্বিতীয় পাসপোর্ট করা হয় রাজ্জাক নামে। এই রাজ্জাক নামের পাসপোর্টের মাধ্যমে তিনি সৌদিতে নিয়মিত বসবাসের সুযোগ পান। ফিঙ্গার প্রিন্টসহ যাবতীয় প্রযুক্তিগত তথ্যাদির সঙ্গে তার মিল পেয়েছে সে দেশের তদন্তসংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা। এই পাসপোর্টের অধীনে তার সৌদির আবাসিক পরিচয়পত্রও (ইকামা) রয়েছে।

এদিকে দেড় বছর ধরে হাবিব কেন কারামুক্ত হতে পারছেন না, সে বিষয়ে জানতে চাইলে হাবিববের আইনজীবী যুগান্তরকে বলেন, ‘তথ্য-প্রমান অনুযায়ী কাগজে-কলমে রাজ্জাককে ইতোমধ্যে কারাগার থেকে মুক্তি দেওয়ার আদেশ দিয়েছেন আদালত। কিন্তু ইন্টারপোলের রেড নোটিশে হাবিবুর রহমান নামের ওপর অভিযোগ দেওয়া হয়। এই নামের সঙ্গে রাজ্জাকের তথ্যপ্রযুক্তিগত মিল না থাকায় জেলখানা থেকে তিনি বের হতে পারছেন না। এই নাম জটিলতা নিরসনে উচ্চ আদালতে যাওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছেন আইনজীবীরা।’

ইন্টারপোলে কেন এমন মিথ্যাচার : মামাশ্বশুর অতিরিক্ত ডিআইজি রফিকুল ইসলামের অস্বাভাবিক ক্ষমতার অপব্যবহার ও তার ভাগনির আত্ম-অহংকারকে পারিবারিক অশান্তির মূল কারণ বলছেন হাবিব। সৌদি আরবের কারাগার থেকে তিনি যুগান্তরকে মুঠোফোনে বলেন, ‘বাংলাদেশে তার জাতীয় পরিচয়পত্রে নাম হাবিবুর রহমান লেখা আছে। ২০-২৫ বছর আগের এই জাতীয় পরিচয়পত্রকে এতটা গুরুত্বও দিইনি। সৌদিতে আসার পর এগুলো মনেও ছিল না। তারপরও একবার সংশোধন করার চেষ্টা করেছিলাম। কিন্তু অফিসপাড়ায় যে জটিল পরিস্থিতি দেখেছি, তাতে বিরক্ত হয়ে আর সংশোধন করতে যাইনি। গ্রেফতারের পর সৌদিতে এক বছর জেল জরিমানাও হয়েছে।’

এক প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেন, ‘তিন সন্তান জন্মের পরও স্ত্রীর উচ্চাভিলাষী জীবনযাপন আমাকে কঠিন সিদ্ধান্ত নিতে বাধ্য করে। ২০১৯ সালের ৩ ফেব্রুয়ারি গোপালগঞ্জের কাজী অফিসের মাধ্যমে স্ত্রীকে তালাক দিই। এরপর থেকেই পদস্থ পুলিশ কর্মকর্তা মামাশ্বশুরের রোষানলে আছি।’

তিনি বলেন, ‘রাজ্জাক নামে পাসপোর্ট থাকায় আমাকে জিম্মি করার চেষ্টা করা হয়েছে বারবার। স্ত্রী যখন সৌদিতে আসে তখন তার পাসপোর্টেও স্বামীর নাম লেখা আছে রাজ্জাক। অথচ উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে আমাকে ফাঁসাতে শেখ রফিকুল ইসলাম ইন্টারপোলে মিথ্যা তথ্য দেওয়া ছাড়াও দেশে আমার পুরো পরিবারকে পুলিশি ক্ষমতায় হেনস্তা করা হয়। ধানমন্ডিতে আমার কেনা ফ্ল্যাট দখল করে তার ভাগনিকে জোর করে বসবাস করার সুযোগ দেওয়া হয়।’

নথিপত্রে দেখা গেছে, তালাকের প্রায় এক বছর পর উর্মি যৌতুকের জন্য মারধর, গুরুতর জখম ও মৃত্যু ঘটানোর সহায়তার অভিযোগ এনে নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইনে আদালতে ৭ জনের বিরুদ্ধে মামলা করেন। মামলাটি ২০২০ সালের ৩ মার্চ ধানমন্ডি থানায় রেকর্ড হয়। মামলায় প্রধান আসামি করা হয়েছে হাবিবুর রহমান রাজ্জাককে। ওই বছরের ১০ নভেম্বর এই মামলায় হাবিবের বিরুদ্ধে গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি করেন আদালত। পরে বাংলাদেশ দূতাবাসের মাধ্যমে গ্রেফতারি পরোয়ানা জারির বিষয়টি সৌদি পুলিশকে জানিয়ে ইন্টারপোলে পাঠানো অভিযোগের সঙ্গে মেলানোর চেষ্টা করা হয়। জেদ্দায় বাংলাদেশ কনস্যুলেট জেনারেল উইংয়ের কাউন্সেলর (শ্রম) মো. আমিনুল ইসলাম ২০২১ সালের ৯ জুন বাংলাদেশ পররাষ্ট্র সচিবকে লিখিতভাবে বিষয়টি অবহিতও করেন। সৌদি আরবের রিয়াদে নিয়োজিত রাষ্ট্রদূত ও পুলিশের সাবেক আইজি ড. মোহাম্মদ জাবেদ পাটোয়ারি এ বিষয়ে যুগান্তরকে বলেন, ‘ইন্টারপোলের যে কোনো বার্তা যদি দূতাবাসের মাধ্যমে আসে তাহলে আমরা জানতে পারব। যদি সরাসরি পুলিশকে পাঠানো হয় তাহলে কোনো তথ্য জানার সুযোগ নেই।’ এক প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেন, ‘যদি ভুল বা অসত্য অভিযোগে উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে একজন প্রবাসীকে ফাঁসানোর চেষ্টা করা হয় তাহলে অবশ্যই তাকে সহযোগিতা করা হবে।’

অভিযোগের বিষয়ে বক্তব্য জানতে ধানমন্ডির বাসায় গিয়ে উর্মির সঙ্গে কথা বলার চেষ্টা করা হয়। পরিচয় পেয়ে তিনি এ বিষয়ে কোনো কথা বলতে রাজি হননি।

মামাকে ফাঁসাতে ধর্ষণ মামলা : শুধু হাবিবই নয়, তার মামা আজম খানের বিরুদ্ধে রাজধানীর বাড্ডা, ধানমন্ডিতে মানব পাচার এবং জয়পুরহাটের পাঁচবিবি ও রাজশাহীতে নারী ও শিশু নির্যাতন আইনে ৪টি মামলা করা হয়। প্রত্যেকটি মামলাই তদন্তে ফাইনাল রিপোর্ট (অভিযোগ মিথ্যা) দেওয়া হয়। প্রকৃত ঘটনা জানার পর পুলিশের শীর্ষ কর্মকর্তাদের সহযোগিতা পেয়েছে এই পরিবার।

রাজশাহীর মামলার বাদী শারমিন আক্তার শাম্মি যুগান্তরকে বলেন, ‘মামলা সম্পর্কে তিনি কিছুই জানেন না।’ অন্যদিকে জয়পুরহাটের পাঁচবিবির নীলা আক্তার বলেন, ‘পাবনার তৎকালীন এসপি (শেখ রফিকুল ইসলাম) তার একটা উপকার করেছিলেন। এজন্য জয়পুরহাটের একজন ডিবি কর্মকর্তা এসপির নির্দেশনা রয়েছে উল্লেখ করে তাকে মামলা করতে উৎসাহিত করেন। আসলে আমি আজম খানকে চিনি না। এরপর ভুল বুঝতে পেরে বিবেকের তাড়নায় নিজেই মামলাটি প্রত্যাহার করে নিই।’ তবে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, এই দুই মামলার বাদী এলাকায় বিতর্কিত নারী হিসাবে পুলিশের কাছে পরিচিত।

অভিযোগের বিষয়ে জনতে চাইলে অতিরিক্ত ডিআইজি শেখ রফিকুল ইসলাম যুগান্তরকে বলেন, কোনো কারণ ছাড়াই হাবিব তিন ছেলেমেয়েসহ আমার ভাগনিকে তালাক দিয়েছে। এর বিচার আল্লাহ করবেন। ছেলেমেয়ের ভরণপোষণ বাবদ কোনো মাসে ২০ হাজার কোনো মাসে ১৫ হাজার টাকা দেওয়া হয়। এতে কি সংসার চলে।

এক প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেন, ইন্টারপোলে আমি অভিযোগ করাইনি। যতদূর জানি সেই অভিযোগ প্রত্যাহার করে নেওয়া হয়েছে।

Check Also

কন্যার ছিন্নভিন্ন দেহ কুড়াচ্ছিলেন মা

অনেক সাধনা। দীর্ঘ প্রতীক্ষা। সংসার পাতার আট বছর পর গিয়াস-রাবেয়া দম্পতির ঘরে জ্যোতি ছড়ায় রায়সা …

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *