কুষ্টিয়া জেলা স্কুলের সিনিয়র শিক্ষিকা রোকসানা খানমের (৫২) কোনো সন্তান ছিল না। তাই ভাইয়ের ছোট ছেলে নওরোজ কবির নিশাতকে ছোটকাল থেকেই নিজের সন্তানের মতো আদর-যত্নে লালন-পালন করেছিলেন। ২০১৩ সালে ভাইয়ের মৃত্যুর পরপরই তাঁর স্ত্রী ও দুই ছেলেকে নিজের বাড়ির একটি ফ্ল্যাটে থাকতে দিয়েছিলেন। এরই মধ্যে নিশাতকে এইচএসসি পাস করিয়েছেন।
ব্যবসা করে খাওয়ার জন্য বাড়ির নিচে একটি মুদি দোকানও করে দিয়েছিলেন। এমনকি এক লাখ ৯০ হাজার টাকা দিয়ে একটি মোটরসাইকেলও কিনেছিলেন ফুফু রোকসানা।
মায়ের মতো সেই ফুফুকে হত্যার অভিযোগে নিশাতকে গ্রেপ্তার করেছে পুলিশ। গতকাল সোমবার তাঁকে আদালতের মাধ্যমে জেলহাজতে পাঠানো হয়েছে।
কুষ্টিয়ার পুলিশ সুপার মো. খাইরুল আলম কালের কণ্ঠকে বলেছেন, ‘নিশাত অত্যন্ত পূর্বপরিকল্পিতভাবে ঠাণ্ডা মাথায় তাঁর ফুফু রোকসানা খানমকে নৃশংসভাবে হত্যা করেছেন। শুধু তাই নয়, হত্যার পরের দিন সকালে তিনি জাতীয় জরুরি সেবা ৯৯৯-এ ফোন করে বলেছেন, তাঁর ফুফুর ফ্ল্যাটের দরজা ভেতর থেকে বন্ধ। অনেক ডাকাডাকির পরও খুলছেন না। পুলিশ এসে যেন সহযোগিতা করে। পরে পুলিশ গিয়ে দরজা ভেঙে রোকসানা খানমের লাশ উদ্ধার করে। ’
সোমবার রাত ১২টার দিকে কুষ্টিয়া শহরের হাউজিং এলাকা থেকে নিশাতকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ। এ ঘটনায় নিহত রোকসানার স্বামী মোস্তাফিজুর রহমান বাদী হয়ে নিশাতের নাম উল্লেখ করে এবং অজ্ঞাতপরিচয় আরো দুই থেকে তিনজনকে আসামি করে থানায় হত্যা মামলা করেছেন।
এর আগে সোমবার সকাল সাড়ে ১১টার দিকে হাউজিং ডি-ব্লকের সাততলা বাড়ির দোতলার ফ্ল্যাট থেকে রোকসানার রক্তাক্ত লাশ উদ্ধার করে পুলিশ। নিঃসন্তান রোকসানা সাততলাবিশিষ্ট নিজ বাড়ির দোতলায় একাই থাকতেন। বাকি ফ্ল্যাটগুলোয় ভাড়াটিয়ারা থাকেন। চারতলার একটি ফ্ল্যাটে থাকেন নিশাতের মা ও বড় ভাই। রোকসানার স্বামী খন্দকার মোস্তাফিজুর রহমান যশোরের চৌগাছা উপজেলায় এলজিইডিতে কমিউনিটি অর্গানাইজার পদে কর্মরত।
পুলিশ জানিয়েছে, রোকসানা হত্যার পর বিশেষ টিম গঠন করেন পুলিশ সুপার। পুলিশ, গোয়েন্দা পুলিশ, র্যাব ও পিবিআইয়ের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা তদন্ত শুরু করেন। আটকের ছয় ঘণ্টা পর নিশাত হত্যাকাণ্ডে জড়িত থাকার কথা স্বীকার করেন। তিনি জানান, ফুফু রোকসানা নিঃসন্তান হওয়ায় ছোটবেলা থেকেই তাঁকে ছেলের মতো আদর করতেন। কিন্তু তিনি উচ্ছৃঙ্খল জীবন যাপন করতেন। মাদক ও অনলাইন জুয়ায় আসক্ত ছিলেন। এ জন্য ফুফু তাঁকে অনেকবার বোঝালেও তিনি শোনেননি। সম্প্রতি নিশাত ফুফুর কিনে দেওয়া মোটরসাইকেলও বিক্রি করে দেন।
নিশাত পুলিশকে জানান, সম্প্রতি রোকসানা তাঁকে টাকা দেওয়া বন্ধ করে দেন এবং বকাঝকা করেন। এতে তিনি ক্ষিপ্ত হয়ে রোকসানাকে হত্যার পরিকল্পনা করেন। গত রবিবার রাতে রোকসানা ছাদের ফুলবাগানে পানি দিতে যান। এ সময় নিশাত ফ্ল্যাটের একটি কক্ষে কৌশলে ঢুকে লুকিয়ে থাকেন। রোকসানা ঘরে ফিরে ঘুমিয়ে যান। রাত দেড়টার দিকে নিশাত রান্নাঘর থেকে শিলপাটার শিল নিয়ে ঘুমন্ত রোকসানাকে মাথায় আঘাত করেন। এতে ঘটনাস্থলে রোকসানার মৃত্যু হয়। নিশাত ঘটনা ভিন্নখাতে নিতে ঘরের আসবাব এলোমেলো করে দেন। হত্যার পর বাসার বারান্দার ওপরের ডিজাইন করা গোল ছিদ্র দিয়ে বের হয়ে যান।
কুষ্টিয়া মডেল থানার ওসি দেলোয়ার হোসেন খান কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘আমরা ঘাতক নিশাতকে গ্রেপ্তার করার পাশাপাশি হত্যায় ব্যবহৃত শিলটি ওই বাড়ি থেকে উদ্ধার করেছি। নিশাত হত্যার কথা স্বীকার করেছেন। তাঁকে আদালতের মাধ্যমে জেলহাজতে পাঠানো হয়েছে। ’