অন অ্যারাইভাল ও ট্যুরিস্ট ভিসায় লিবিয়ায় নি’হত ২৬ বাংলাদেশিকে পাঠানো হয়েছিল। মানবপাচারে সক্রিয় দেশীয় দালালরা প্রথমে ঢাকায় অবস্থান নেয়। পরে বেনগাজিতে মানবপাচারের জন্য স্থানীয় দালালদের কাছ থেকে প্রাপ্ত পাসপোর্টগুলো স্ক্যান করে সফট কপি দুবাই এবং লিবিয়াতে পাঠায়। সেখান থেকে ট্যুরিস্ট ভিসা এবং অন অ্যারাইভাল মোয়াফাকা সংগ্রহ করার পরে বেনগাজিতে ক্যাম্পে নির্ধারণ করে। এরপর বিভিন্ন চুক্তিতে ভিকটিমদের লিবিয়া পাঠানোর প্রক্রিয়া শুরু করে দালালরা।
সোমবার (৮ জুন) দুপুরে ডিএমপি’র মিডিয়া অ্যান্ড পাবলিক রিলেশন্স বিভাগে আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে ডিএমপি’র অতিরিক্ত পুলিশ কমিশনার (ডিবি) আবদুল বাতেন এসব কথা জানান। লিবিয়ায় ২৬ বাংলাদেশি হ’ত্যা ও মানব পাচারের ঘটনায় জড়িত নয়জনকে গ্রেফতার করেছে ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশ (ডিবি) ও অপরাধ তদন্ত বিভাগ (সিআইডি)।
গ্রেফতারকৃতরা হলেন- বাদশা মিয়া, জাহাঙ্গীর মিয়া, আকবর আলী, সুজন, নাজমুল হাসান, লিয়াকত শেখ ওরফে লিপু, সোহাগ হোসেন, খালিদ চৌধুরী ও মোছা. সানজিদা (৩৮)। এ সময় তাদের কাছ থেকে চারটি পাসপোর্ট, দুইটি মোবাইল ফোন ও টাকার হিসাব সম্বলিত দুইটি নোট বুক উদ্ধার করা হয়।
অপরদিকে রাজধানীর বিভিন্ন স্থানে অভিযান চালিয়ে এ চক্রের আরো তিনজনকে গ্রেফতার করেছে পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ (সিআইডি)। সোমবার সিআইডির অর্গানাইজড ক্রাইম বিভাগের সিরিয়াস ক্রাইম ইউনিট তাদের গ্রেফতার করে। গ্রেফতারকৃতরা হলেন- সোহাগ হোসেন (৫০), খালিদ চৌধুরী (৪২) ও মোছা. সানজিদা (৩৮)। গ্রেফতারকৃত আসামিদের বিরুদ্ধে সিআইডি বাদী হয়ে পল্টন থানায় দুটি ও বনানী থানায় একটি মানবপাচার মামলা দায়ের করেছে। এই পর্যন্ত মানবপাচার সংক্রান্ত সারাদেশে দায়েরকৃত ১২টি মামলা তদন্ত করছে সিআইডি।
এদিকে, ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের হাতে গ্রেফতার বাদশা মিয়া, জাহাঙ্গীর মিয়া ও লিয়াকত শেখ ওরফে লিপুকে পাঁচ দিন করে রি’মান্ড মঞ্জুর করেছেন আদালত। সোমবার ঢাকা মহানগর হাকিম বাকী বিল্লাহ শুনানি শেষে এ রি’মান্ড মঞ্জুর করেন। এদিন তাদের তিনজনকে আদালতে হাজির করে পুলিশ। এ সময় রাজধানীর পল্টন থানায় করা ৩(৬)২০ মামলার মূল রহস্য উদঘাটনের জন্য আসামি বাদশা মিয়া ও জাহাঙ্গীর মিয়াকে ১০ দিনের রি’মান্ডে নিতে আবেদন করেন মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা। পল্টন থানার ৭(৬)২০ আরেক মামলার সুষ্ঠু তদন্তের জন্য আসামি লিয়াকত শেখকে সাত দিনের রি’মান্ডে নিতে আবেদন করেন মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা।
শুনানি শেষে বিচারক প্রত্যেকের পাঁচ দিন করে রি’মান্ড মঞ্জুর করেন। এছাড়া সুজন মিয়া নামে একজন আসামি ১৬৪ ধারায় আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিয়েছেন। অপর দুই আসামি আকবর আলী ও নাজমুল হাসানকে কারাগারে পাঠানোর আদেশ দিয়েছেন আদালত।
সংবাদ সম্মেলনে ডিএমপি’র অতিরিক্ত পুলিশ কমিশনার (ডিবি) মো. আবদুল বাতেন বলেন, ‘লিবিয়ার বিভিন্ন এস্টেটে কাজ ও লিবিয়া থেকে ইউরোপের বিভিন্ন দেশে নেওয়ার প্রলোভন দেখিয়ে বাংলাদেশি দালালরা অন অ্যারাইভাল ভিসা ও ট্যুরিস্ট ভিসার মাধ্যমে লোকজন লিবিয়ায় পাচার করে। লিবিয়ায় পাচারের পর ভিকটিমদের লিবিয়ার বিভিন্ন ক্যাম্পে আটক রেখে অমানুষিক শারীরিক এবং মানসিক নি’র্যাতন করে তারা। নি’র্যাতিত ভিকটিমদের কান্নাকাটি, আকুতি-মিনতি করা অডিও অথবা সরাসরি মোবাইলে কথাবার্তা বাংলাদেশে অবস্থানরত তাদের মা-বাবা, আত্মীয়-স্বজনদেরকে পাঠিয়ে টাকা দাবি করে।
ভিকটিমদের বাঁচাতে তার আত্মীয়-স্বজন অনেক ক্ষেত্রে ভিটাবাড়ি বিক্রি করে টাকা পাঠায়। নি’হত মাদারীপুরের সাত জনকে বাংলাদেশ থেকে লিবিয়ায় আমির হোসেনের কাছে পাচার করেছিল আকবর আলী। গ্রেফতার বাদশা মিয়া ১৩ বছর ধরে লিবিয়ায় অবস্থান করেছিলেন। লিবিয়ার বেনগাজী জোয়ারা শহরে তার নিজস্ব ক্যাম্প আছে। সমগ্র বাংলাদেশ থেকে সে নিয়মিত লিবিয়ায় মানব পাচার করে। পাচারকৃত বাংলাদেশিদের তার ক্যাম্পে আটক রেখে সমুদ্রপথে ইতালি পাঠানোর ট্রেনিং দেওয়ায়। মাদারীপুরের নি’হতদের মধ্যে চার জনকে তার ক্যাম্পে আটক রেখে লিবিয়ার ত্রিপোলিতে পাচার করার এক পর্যায়ে এ হ’ত্যাকাণ্ড ঘটে।
সংবাদ সম্মেলনে আবদুল বাতেন বলেন, ‘গ্রেফতারকৃত জাহাঙ্গির আলম ঢাকায় অবস্থান করে নিজস্ব কায়দায় বেনগাজিতে মানব পাচার ছাড়াও স্থানীয় অন্যান্য দালালদের কাছ থেকে প্রাপ্ত পাসপোর্টগুলো স্ক্যান করে সফট কপি দুবাই এবং লিবিয়াতে প্রেরণ করে ট্যুরিস্ট ভিসা, অন অ্যারাইভাল মোয়াফাকা সংগ্রহ করার পরে বেনগাজির ক্যাম্প নির্ধারণ করে। গ্রেফতার সুজন ভিকটিম ইছার উদ্দিন, বিজয় ও সজলকে লিবিয়ায় পাঠিয়েছেন। গত ২৮ মে লিবিয়ায় ট্র্যাজেডিতে ভিকটিম মো. সজল আ’হত হয়ে লিবিয়ায় এক হাসপাতালে চিকিৎসাধীন আছেন। নিখোঁজ মো. বিজয় ও ইছার উদ্দিনের কোনো সন্ধান মেলেনি এখনো।’
[৯] উল্লেখ্য, গত ২৮ মে লিবিয়ার সাহারা মরুভূমি অঞ্চলের মিজদা শহরে ২৬ বাংলাদেশিসহ ৩০ জনকে গু’লি করে হ’ত্যা করা হয়। এতে আ’হত হয় আরো ১১ জন।