Breaking News

জেলা পরিষদ নির্বাচনে এক ভোট ২ লাখ, কসম খেয়েও দিয়েছেন আরেকজনকে

এক ভোট দুই লাখ টাকা। ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলা পরিষদ নির্বাচনে ভোট কেনাবেচার সর্বোচ্চ রেট। আর এটি ঘটেছে সরাইলে। সেখানে ৪ সদস্য প্রার্থী পাল্লা দিয়ে ভোট কিনেছেন বলে অভিযোগ উঠেছে। সাধারণ সদস্য প্রার্থী কয়েকজনের খরচ কোটি টাকা। ৫০ লাখ টাকা খরচ করেছেন আরও বেশ কয়েকজন প্রার্থী। নারী সদস্য প্রার্থীরাও কম যাননি। ভোটের লড়াইয়ে তাদেরও খরচ করতে হয়েছে ৪০/৪৫ লাখ টাকা। এর বাইরে কোন কোন প্রার্থী এলাকার প্রভাবশালী জনপ্রতিনিধি, নেতাদেরও টাকা দিয়েছেন। নির্বাচনী প্রচারের খরচাপাতি এই হিসেবের বাইরে।

প্রার্থীর যোগ্যতা, ইমেজ, শিক্ষাদীক্ষা, সর্বোপুরি দায়িত্বপালনে কতটুকু সক্ষম এসব কিছুর মূল্যায়ন না করে টাকার অংক বিচারে রায় দিয়েছেন ভোটাররা। বিশেষ করে ইউপি চেয়ারম্যান ও সদস্যরা নীতি-নৈতিকতার ধার না ধরে যতজন প্রার্থী ততজনের কাছ থেকেই চুক্তি করে টাকা নিয়েছেন। এমনকি কসম খেয়ে টাকা নিয়েও ভোট দেননি বলে অভিযোগ করেন ড. বদিউল আলম।

ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলা পরিষদে চেয়ারম্যান ও সদস্য পদে ৫৮ জন প্রার্থী প্রতিদ্বন্ধিতা করেন। সোমবার অনুষ্ঠিত নির্বাচনে ভোট দেয়ার প্রতিশ্রুতিতে এই জেলায় ১০ কোটি টাকার বেশি হাতিয়েছেন চেয়ারম্যান-মেম্বাররা। মোট কথা যত প্রার্থী তাদের দুয়ারে ধর্না দিয়েছেন সবার কাছ থেকেই টাকা নিয়েছেন ভোটাররা। এর মধ্যে ব্যতিক্রম ২০/৩০ জন।

আনুমানিক এক হিসেবে দেখা গেছে নির্বাচনের ১৩৮২ ভোটার ২ চেয়ারম্যান প্রার্থীর কাছ থেকে গড়ে ১০ হাজার করে ২০ হাজার টাকা পেয়েছেন। আর ৫৬ সদস্য প্রার্থীর কাছ থেকে একেকজন কামিয়েছেন ৫০ হাজার টাকা করে।

তবে সরাইল উপজেলার ভোট বাণিজ্য রেকর্ড সৃষ্টি করেছে। এটি জেলা পরিষদের ২ নম্বর ওয়ার্ড। এখানে সাধারণ সদস্য পদে প্রতিদ্বন্ধিতা করেন ৬ জন। এরমধ্যে ৪ প্রার্থী পাল্লা দিয়ে টাকা উড়িয়েছেন। তাদের মধ্যে ৩ জন কোটি টাকার ঘর ছুঁয়েছেন। একজন এক লাখ টাকায় ভোট কিনলে আরেকজন দিয়েছেন দেড়লাখ টাকা। সবশেষ দু’লাখ টাকা দিয়েও ভোট কিনেছেন এক প্রার্থী। আলোচনা ছড়িয়েছে কোটি টাকার বিনিময়ে এই প্রার্থীদের কেউ ১৬/১৭ ভোট পেয়েছেন। সে হিসেবে একেকটি ভোটের মূল্য পড়েছে প্রায় ৫ লাখ টাকা। এখানে জয়ী হয়েছেন পায়েল হোসেন মৃধা। তার প্রাপ্ত ভোট ৩৭। তার নিকটতম প্রতিদ্বন্দ্বী মোহাম্মদ জাকির হোসেন পেয়েছেন ৩৩ ভোট। বিজয়ী পায়েল হোসেন মৃধা দাবি করেন-এতো টাকা খরচ করার সামর্থ্য তার নেই। সবার কাছে শুনেছি প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থীরা অনেক টাকা খরচ করেছেন।

সরাইলের নোয়াগাঁও ইউনিয়নে সংরক্ষিত ওয়ার্ডের এক নারী সদস্য প্রার্থীর কাছে প্রতি ভোটের জন্য ২০ হাজার টাকা করে দাবি করেন সেখানকার ৯ জন ইউপি সদস্য। ভোট বিক্রির টাকার অংক সাব্যস্তকারী ওই ইউনিয়নের ৫ নম্বর সদস্য ফারুক মিয়া বলেন-টাকার চিন্তা করে কি ভোট দেয়া যাইবো। ২০ হাজার টাকা করে চাইছি এর কোন প্রমাণ নাই। এর আগে ওই প্রার্থীকে এক হোটেলে বসিয়ে সাড়ে ৫ হাজার টাকার খাবার খান ওই ইউপি সদস্যরা। এক হাজার টাকার ৬টি নোট বিল পরিশোধের জন্য দিলে ফেরত ৫’শ টাকা ক্যাশ থেকে নিয়ে যান ভোটার এক ইউপি সদস্য। এরপর প্রার্থীর কাছে গাড়ি ভাড়া দাবি করেন বাড়ি যাওয়ার জন্য।নাসিরনগর জেলা পরিষদের ১ নম্বর ওয়ার্ড। এখানে ভোটার সংখ্যা ১৭২। এক সদস্য প্রার্থী জানান- এই ভোটারদের মধ্যে ১৩৫ জনকে তিনি ৫ হাজার টাকা করে দিয়েছেন। তাদের সবাই ভোট দেয়ার কসম খেয়ে টাকা নেন। কিন্তু ভোটে ফল হয়েছে অন্যরকম। কসমখোররা কেউই তাকে ভোট দেয়নি। বুড়িশ্বর ইউনিয়নের সদস্য আবদুল লতিফ তার নিজের এবং বাকি ৮ সদস্য প্রার্থীর ভোটের জন্য ২০ হাজার টাকা করে দাবি করেন প্রার্থীদের কাছে। তবে আবদুল লতিফ বলেন-টাকা ছাড়াই ভোট দিয়া দিছি। তবে এক চেয়ারম্যান প্রার্থীর কাছ থেকে ১ হাজার টাকা পেয়েছেন বলে স্বীকার করেন। ফান্দাউক ইউনিয়নের ভোটাররা বেশি নিয়েছে বলে জানান লতিফ। তাদের কেউ ১০ হাজার, কেউ ১৫ হাজার টাকা করে নিয়েছে।

সংরক্ষিত ১ নং ওয়ার্ডের (আশুগঞ্জ,সরাইল ও নাসিরনগর) একজন নারী সদস্য প্রার্থী জানান- তার ওয়ার্ডের প্রায় ৪’শ ভোটারের মধ্যে ৩’শ জনকেই খাম দিয়েছেন। প্রত্যেক খামে ছিলো ৫ হাজার টাকা করে। এই খবর পেয়ে প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থী ৮ থেকে ১০ হাজার টাকায় ভোট কিনে নেন।

সংরক্ষিত ২ নং ওয়ার্ডের (ব্রাহ্মণবাড়িয়া সদর,বিজয়নগর ও কসবা উপজেলা) একজন প্রার্থী জানান-টাকা যে কীভাবে খরচ হয়েছে তা বলতে পারবো না। আত্মীয় স্বজনও টাকা খরচ করেছেন। আনুমানিক ৩৮/৪০লাখ টাকা খরচ হয়েছে এমনই হিসেব তার।

সংরক্ষিত ৩ নম্বর ওয়ার্ডের এক সদস্য প্রার্থী জানান-তার প্রতিদ্বন্দ্বী যেখানে ৫ হাজার দিয়েছেন, সেখানে তারা ১০ হাজার টাকা দিয়েছেন। এর বাইরেও আমরা টাকা দিয়েছি। কোটি টাকা খরচ হলেও জয় ছিলো আমাদের লক্ষ্য। একটা ভোটার কাকে ধরলে ঘুরবে তারেও টাকা দিয়েছি। এখানে ৪ নারী প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেন।

নবীনগর উপজেলায়(৮নং ওয়ার্ড) ৩ সদস্য প্রার্থী টাকা খরচ করেছেন বস্তা ভরে। এর মধ্যে ২ জনের খরচ কোটি টাকার কাছাকাছি। মো. নাসির উদ্দিন নামে এক প্রার্থীর জন্যে এলাকার সংসদ সদস্য নিজেই ৫০ হাজার টাকা করে কয়েকটি ইউনিয়নের ভোট কিনেন বলে প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থীরা অভিযোগ করেন। সাথে একটি করে মোবাইলও দেয়া হয়। ভোটের এক সপ্তাহ আগে থেকে টাকা ও মোবাইল দেয়ার বিষয়ে প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থীরা রিটার্নিং কর্মকর্তার কাছে দফায় দফায় অভিযোগ দেন। এক ইউপি চেয়ারম্যান জেলা পরিষদের ওই সদস্য প্রার্থীর কাছ থেকে ৫০ হাজার টাকা পাওয়ার কথা স্বীকার করেন। প্রতিদ্বন্দ্বী এক সদস্য প্রার্থী জানান-সে যেখানে ৫০ হাজার দিয়েছে সেখানে আমি ৭০ বা ৮০ হাজার, কোথাও এক লাখ টাকা পর্যন্ত দিয়েছি। এছাড়া সাবেক এক এমপি ২১ ইউনিয়নে দলের চেয়ারম্যান প্রার্থীর জন্য নির্বাচনের ২ দিন আগে ৫ হাজার টাকার খাম পাঠান। এই টাকায় ভোটের ফল পরিবর্তন হয় বলে তাকেই চেয়ারম্যান জয়ের নায়ক বলা হচ্ছে এখন। তিনি সদস্য প্রার্থীদেরও টাকা দিয়েছেন।

আশুগঞ্জ উপজেলায়(৩ নম্বর ওয়ার্ড) প্রতিদ্বন্দ্বী ৪ প্রার্থীর মধ্যে টাকা খরচের দিক দিয়ে আলোচিত ব্যবসায়ী বিল্লাল মিয়া। ৬০ ভোট পেয়ে জয় পেয়েছেন তিনি। ৫০ থেকে ৬০ হাজার টাকায় একেকটি ভোট কিনেছেন বলে আলোচনা ছড়িয়েছে। তার ব্যয় ৫০/৬০ লাখ টাকা। তবে বিল্লাল মিয়া বলেছেন-মানুষ কত কথাই বলে। নিয়মের বাইরে আমি কোন টাকা খরচ করিনি। এছাড়া সদর উপজেলা, আখাউড়া, কসবা, বাঞ্ছারামপুর এবং বিজয়নগর উপজেলায় প্রতিদ্বন্দ্বী সদস্য প্রার্থীরা ভোটারদের টাকা দিয়েছেন বলে জানা গেছে।

এ বিষয়ে ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলা নাগরিক ফোরামের সভাপতি পীযূষ কান্তি আচার্য জানান, জেলা পরিষদ নির্বাচনে টাকা ছড়াছড়ির বিষয়টি বিভিন্ন গণমাধ্যমের খবরে জানতে পেরেছি আসলে এটি গণতন্ত্রের জন্য হুমকি। টাকা দিয়ে ভোট কেনার কারণে প্রকৃত জনপ্রতিনিধি নির্বাচিত হচ্ছে না বলে আমি মনে করি। নির্বাচনে টাকা ছড়াছড়ি কীভাবে বন্ধ করা যায় এই ব্যাপারে সরকারকেই উদ্যোগ নিতে হবে।

Check Also

ক্ষমা চাইলেন ডা. মুরাদ

আওয়ামী লীগ সভাপতি ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কাছে সাধারণ ক্ষমার আবেদন করেছেন সাবেক তথ্য ও …

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *