সাহাবুদ্দিন মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে করোনা পরীক্ষা নিয়ে ভয়াবহ জালিয়াতিতে জড়িয়ে মোটা অঙ্কের অর্থ হাতিয়ে নেওয়ার নেপথ্যে রয়েছেন হাসপাতালটির প্রতিষ্ঠাতা মোহাম্মদ সাহাবুদ্দিনের ছেলে ফয়সাল আল ইসলাম। তিনি প্রতিষ্ঠানটির ব্যবস্থাপনা পরিচালক। র্যাবের হাতে গ্রেপ্তার হাসপাতালের সহকারী পরিচালক আবুল হাসনাত ও ইনভেন্টরি অফিসার শাহরিজ কবির তার ঘনিষ্ঠ সহযোগী। তারাই অনুমোদনহীন র্যাপিড টেস্ট কিট চোরাই পথে চীন থেকে আমদানি করেছিলেন।
এমনকি অনুমোদনহীন স্পর্শকাতর বিভিন্ন ওষুধও তারা চোরাই পথে আমদানি করেন। করোনার অ্যান্টিবডি পরীক্ষা, পরীক্ষা না করেই পজিটিভ রিপোর্ট দিয়ে রোগী ভর্তি এবং ভুয়া বিল-ভাউচার করে অর্থ হাতিয়ে নিচ্ছিল তারা। বিভিন্ন সরকারি হাসপাতাল থেকে দালালদের মাধ্যমে রোগী ভাগিয়ে আনা হয়েছে বলেও অভিযোগ রয়েছে। শিগগিরি হাসপাতালটি সিলগালা করা হবে। গত রবিবার সাহাবুদ্দিন মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে অভিযানের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট র্যাব কর্মকর্তারা এসব তথ্য জানিয়েছেন।
র্যাব বলছে, সাহাবুদ্দিনের ছেলে ফয়সাল ও তার সহযোগীরা মানি লন্ডারিংয়ের মতো গুরুতর অপরাধেও জড়িয়ে পড়েন। এ সংক্রান্ত তথ্য-উপাত্ত সংগ্রহ করার কাজ চলছে। তাদের বিরুদ্ধে মানি লন্ডারিং আইনে ব্যবস্থা নেওয়ার বিষয়টিও প্রক্রিয়াধীন রয়েছে। জালিয়াতির ঘটনায় গতকাল রবিবার রাজধানীর গুলশান থানায় হাসপাতালের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ফয়সাল আল ইসলাম, সহকারী পরিচালক আবুল হাসনাত এবং ইনভেন্টরি অফিসার শাহরিজ কবিরের নাম উল্লেখ করে মামলা করেছে র্যাব। মামলায় অজ্ঞাত আরও ৪-৫ জনকে আসামি করা হয়েছে।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, জালিয়াতির নাটের গুরু ফয়সাল আল ইসলাম করোনা ভাইরাসে আক্রান্ত। তিনি একটি হোটেলে কোয়ারেন্টিনে আছেন। ফয়সাল যেন পালিয়ে যেতে না পারেন সে জন্য তাকে গোয়েন্দা নজদারিতে রাখা হয়েছে।
এদিকে র্যাবের অভিযানের খবর পেয়ে সাহাবুদ্দিন মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের মূল সার্ভার থেকে গুরুত্বপূর্ণ সব তথ্য মুছে ফেলা হয়েছে। র্যাব হাসপাতাল থেকে সার্ভার রুমের কম্পিউটারের হার্ডডিস্ক জব্দ করেছে। সেখানে হাসপাতালের জুন মাসের বিলের তথ্য এবং করোনা পরীক্ষাসংক্রান্ত কোনো তথ্যই নেই। এখন প্রযুক্তির সহায়তায় মুছে ফেলা তথ্যগুলো উদ্ধারের চেষ্টা চলছে।
র্যাবের নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট সারোয়ার আলম বলেন, প্রতারণার অভিযোগে সাহাবুদ্দিন মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের ব্যবস্থাপনার সঙ্গে জড়িতের বিরুদ্ধে নিয়মিত মামলা করা হয়েছে। মামলার আসামিদের মধ্যে দুজন গ্রেপ্তার আছেন। জালিয়াতির সঙ্গে জড়িত অন্যদের অবশ্যই আইনের আওতায় আনা হবে। এ জন্য প্রয়োজনীয় সবই করা হবে।
এই হাসপাতালটির লাইসেন্স নেই জানিয়ে সারোয়ার আলম বলেন, গত বছর জুন মাসে হাসপাতালটির লাইসেন্সের মেয়াদ শেষ হয়। তার পর তারা আর সেটি নবায়ন করেনি। তবে রিজেন্ট হাসপাতালে অভিযানের পর তারা লাইসেন্স নবায়নের আবেদন করেন। লাইসেন্স এখনো নবায়ন হয়নি।
র্যাবের কর্মকর্তারা জানান, হাসপাতালটির মূল উদ্দেশ্য হচ্ছে ভুয়া বিলের মাধ্যমে বাণিজ্য করা। রোগীদের বিল বাড়াতে একই টেস্ট বারবার দেখিয়ে অতিরিক্ত বিলও যোগ করা হচ্ছিল। কোভিড-১৯ নেগেটিভ রোগীদের ভুয়া পজিটিভ রিপোর্ট দিয়ে তাদেরও ভর্তি করা হতো। পাশাপাশি প্রয়োজনের তুলনায় অতিরিক্ত নানা টেস্ট দেখিয়ে আইসিউ ও কেবিনে রেখে বানানো হতো মোট অঙ্কের বিল।
র্যাবের এক কর্মকর্তা জানান, হাসপাতালের সহকারী পরিচালক আবুল হাসনাতের কক্ষ থেকে র্যাপিড টেস্ট কিট দিয়ে পরীক্ষার বেশকিছু রিপোর্ট উদ্ধার করা হয়েছে। এগুলোয় বায়োকেমিস্ট, টেকনোলজিস্টসহ সংশ্লিষ্টদের স্বাক্ষর রয়েছে। তবে হাসনাতকে জিজ্ঞাসাবাদে জানা গেছে, সব স্বাক্ষর তিনি নিজেই করেছেন। এসব কাজ তিনি হাসপাতালের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ফয়সাল আল ইসলামের নির্দেশে করেছেন।
র্যাবের দায়িত্বশীল সূত্র জানায়, হাসপাতালটি আরটিপিসিআর ল্যাবে করোনার নমুনা পরীক্ষার অনুমোদন পেয়েছিল ৫ জুন। আরটিপিসিআর ল্যাব না থাকা এবং অবকাঠামো সুবিধা না থাকার কারণে পরে এই অনুমোদন বাতিল করা হয়। তবে তারা এই পরীক্ষা অব্যাহত রেখেছিল। এ ক্ষেত্রে অনুমোদনহীন র্যাপিড টেস্ট কিট ব্যবহার করে আসছিল। কোনো কোনো ক্ষেত্রে এটাও ব্যবহার না করেই ভুয়া রিপোর্ট তৈরি করে বিপুল পরিমাণ অর্থ হাতিয়ে নেন। তবে কী পরিমাণ রোগীর কাছ থেকে অর্থ হাতিয়ে নিয়েছে এ সংক্রান্ত তথ্য এখনো জানা সম্ভব হয়নি। এ বিষয়ে আবুল হাসনাতসহ গ্রেপ্তার দুজন মুখ খুলছেন না।
এদিকে র্যাবের অভিযানে ওই হাসপাতালের অপারেশন থিয়েটার থেকে নিম্নমানের সার্জিক্যাল সামগ্রী উদ্ধার করা হয়। এমনকি কোনো কোনো স্পর্শকাতর সার্জিক্যাল সামগ্রীর মেয়াদ শেষ হয়েছে ২০০৯ সালে। এগুলো তারা অপারেশন থিয়েটারে রোগীকে অজ্ঞান করার কাজে ব্যবহার করছিল।
হাসপাতাল ছাড়ছেন রোগীরা : র্যাবের অভিযানের পর সাহাবুদ্দিন মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতাল ছেড়ে যাচ্ছেন রোগীরা। র্যাব বলছে, রোগীশূন্য হলে হাসপাতালটি সিলগালা করা হবে। হাসপাতালের তথ্যকেন্দ্র থেকে জানানো হয়, নতুন কোনো রোগী তারা ভর্তি নিচ্ছেন না। সকাল থেকে দুজন এসেছিলেন তাদের ফিরিয়ে দেওয়া হয়েছে। আর যারা ভর্তি ছিলেন তাদের মধ্যে পাঁচজন র্যাবের অভিযানের পর থেকে বিকালের মধ্যে হাসপাতাল ছেড়ে গেছেন।
গতকাল বিকালে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, হাসপাতালের কোভিড-১৯ ইউনিটে ১৪ জন এবং অন্য একজন সাধারণ রোগী ভর্তি রয়েছে।