প্রেমিকার দেহ কেটে টুকরো টুকরো করে ফ্রিজে ভরে রেখেছিলেন। এরপর প্রতিদিন একাধিক নারীকে বাড়িতে ডেকে মেতেছেন উদ্দাম যৌনতায়। তার কীর্তি ফাঁস হয়েছে দীর্ঘ ৬ মাস পর। কিন্তু সমাজমাধ্যমে নিজের ‘অন্য রূপ’ তৈরি করে রেখেছিলেন তিনি। যা দেখে বোঝার উপায় নেই, তিনি আদতে কতটা ‘নৃশংস খুনি’ হয়ে উঠতে পারেন।
প্রেমিকাকে খুন করে ৩৫ টুকরো করে ফ্রিজে রেখে দিয়েছিলেন আফতাব আমিন পুণাওয়ালা। দিল্লির সেই ঘটনা প্রকাশ্যে আসার পর কার্যত তোলপাড় পড়ে গিয়েছে। আফতাবের নৃশংসতায় শিউরে উঠেছে গোটা ভারত।
প্রেমিকা শ্রদ্ধার টুকরো টুকরো দেহাংশ ফ্রিজে রেখে আফতাব অন্য মেয়েদের সঙ্গে একই বাড়িতে শারীরিক সম্পর্কে লিপ্ত হতেন। শ্রদ্ধাকে খুনের পর একাধিক নারীকে বাড়িতে ডেকে আফতাব মাততেন উদ্দাম যৌনতায়!
আফতাবের ফেসবুক প্রোফাইল ঘেঁটে দেখা গিয়েছে, সেখানে ‘উদার’, ‘নারীবাদী’ হিসাবে নিজের সম্পর্কে একটি ধারণা তৈরি করে রেখেছিলেন তিনি। এমনকি আফতাব নিজেকে এলজিবিটিকিউ সমর্থক হিসাবেও দেখিয়েছিলেন। তার প্রোফাইল ঘাঁটলে মনে হবে, তিনি এক জন পরিবেশপ্রেমী। ২০১৭ সালে আফতাব ফেসবুকে একটি পোস্ট করেছিলেন, যেখানে মুম্বাইয়ের আবহাওয়া নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করা হয়েছিল। অ্যারে জঙ্গল কেটে মেট্রো পরিষেবা বর্ধিত করার পরিকল্পনা নিয়েছিল তৎকালীন উদ্ধব ঠাকরে সরকার। সেই প্রসঙ্গে জঙ্গল কাটার বিরুদ্ধে মুখ্যমন্ত্রীকে একটি পিটিশন দেওয়ার জন্য উদ্যোগী হয়েছিলেন আফতাব। ফেসবুকে সকলের কাছে তা নিয়ে সমর্থন চেয়ে পোস্ট করেছিলেন।
এর আগে ২০১৬ সালে আফতাবের একটি পোস্টে জল সংরক্ষণের বার্তা ছিল। জল সংরক্ষণের প্রয়োজনীয়তা সম্পর্কে জানিয়ে ৪০টি ছবি সমন্বিত একটি প্রতিবেদনের লিঙ্ক পোস্ট করেছিলেন আফতাব। ২০১৫ সালে আফতাবের একটি পোস্ট বলছে, কালীপুজায় বাজি ফাটানো উচিত নয়।
২০১৫ সালেই আফতাবের আরও একটি পোস্টে দেখা যায়, নারীদের উপর অ্যাসিড হামলার বিরোধিতা করা হয়েছে। এ ছাড়া, এলজিবিটিকিউ সম্প্রদায়ের সমর্থনে এক বার নিজের ফেসবুক প্রোফাইলের মূল ছবিতে রামধনু রঙের প্রলেপ লাগিয়েছিলেন আফতাব।
দিল্লির মেহরুলিতে একসঙ্গে থাকতেন আফতাব আমিন পুনাওয়ালা এবং তার প্রেমিকা শ্রদ্ধা। মেহরুলির সেই ফ্ল্যাটেই নতুন একটি ফ্রিজ কিনে সেখানে মার্কিন টিভি সিরিজের চরিত্র ‘ডেক্সটার’ ভঙ্গিতে শ্রদ্ধার মৃতদেহের ৩৫ টুকরো করে রেখেছিল আফতাব। মোট ১৮ দিন যাবত মৃতদেহের অংশগুলি বিভিন্ন জায়গায় নিয়ে গিয়ে ফেলে এসেছিল আফতাব। এই ১৮ দিনের সময়কালে নিজের ফ্ল্যাটে একাধিক যৌনসঙ্গীকে আমন্ত্রণ জানিয়েছিল আফতাব।
শ্রদ্ধাকে খুন করার পর একাধিক নারীর সঙ্গে ডেটিং অ্যাপে আলাপ করে আফতাব। তাদের সঙ্গে দেখাও করে সে। এবং নিজেরই ফ্ল্যাটে তাদের সঙ্গে যৌন সম্পর্কেও জড়িয়েছিল আফতাব। সেই সময় ফ্ল্যাটের এক কোণে দাঁড়িয়ে থাকা ফ্রিজে জমে পড়েছিল তার প্রেমিকার কয়েক টুকরো দেহাংশ। দিল্লি পুলিশ জানিয়েছে, এই ১৮ দিনের সময়কালে অনেকেই আফতাবের ফ্ল্যাটে এসেছিল। তখন ফ্ল্যাটে রুম ফ্রেশনার দেওয়া থাকত। ধূপকাঠি জ্বলত। এই আবহে কেউই এটা ভেবে উঠতে পারেনি যে ফ্ল্যাটে থাকা ফ্রিজে টুকরো করা মৃতদেহ থাকতে পারে।
মুম্বাইতে প্রথম সাক্ষাত হয়েছিল আফতাব এবং শ্রদ্ধা ওয়াকারের। তবে শ্রদ্ধার পরিবার এই সম্পর্ক মেনে না নেওয়ায় তারা দিল্লিতে পালিয়ে এসেছিল চলতি বছরের এপ্রিল নাগাদ। এরপরই মে মাসেই নাকি খুন করা হয়েছিল শ্রদ্ধাকে। জেরায় আফতাব জানিয়েছে, শ্রদ্ধা তার ওপর বিয়ে করার জন্য চাপ দিচ্ছিল। এদিকে পুলিশ জানতে পেরেছে, শ্রদ্ধার সঙ্গে সম্পর্কে থাকা সত্ত্বেও ডেটিং অ্যাপ ব্যবহার করে চলছিল আফতাব। যা নিয়ে দুজনের মধ্যে মনোমালিন্য লেগেই থাকত।
পুলিশের দাবি, শ্রদ্ধাকে চলতি বছরের মে মাসে খুন করা হয়েছিল। মুম্বাই থেকে দিল্লিতে চলে আসার মাস খানের পরেই প্রেমিকা তথা লিভ-ইন সঙ্গীকে মেরে ফেলেন আফতাব।
কেন শ্রদ্ধাকে খুন? পুলিশের প্রশ্নের মুখে আফতাব জানিয়েছেন, শ্রদ্ধা তাকে বিয়ের জন্য চাপ দিচ্ছিলেন। কিন্তু তিনি আদতে লিভ-ইন সম্পর্কেই থাকতে চাইতেন। এই নিয়ে তাদের মধ্যে ঝগড়াঝাঁটি লেগেই থাকত। তার জেরেই খুন করেছেন তিনি।
পুলিশ জানতে পেরেছে, ডেটিং অ্যাপে মেয়েদের সঙ্গে আলাপ জমানো, সম্পর্ক তৈরি করার স্বভাব আফতাবের আগে থেকেই ছিল। তা জানতে পেরেছিলেন শ্রদ্ধাও। সেই নিয়েও দুজনের মধ্যে বিবাদ চরমে পৌঁছেছিল।
পুলিশি জেরার মুখে আফতাব পাল্টা দাবি করেছেন, একই ডেটিং অ্যাপ ব্যবহার করতেন শ্রদ্ধা। তিনিও ওই অ্যাপের মাধ্যমে অন্য ছেলেদের সঙ্গে মিশতেন।
শ্রদ্ধাকে শ্বাসরুদ্ধ করে খুন করেছিলেন আফতাব। তার পর প্রেমিকার দেহ ধারালো অস্ত্র দিয়ে টুকরো টুকরো কাটেন তিনি। মোট ৩৫টি টুকরো করা হয় শ্রদ্ধার দেহের।
খুনের পর ৩০০ লিটারের একটি নতুন ফ্রিজ কিনে এনেছিলেন আফতাব। শ্রদ্ধার দেহের টুকরোগুলিকে প্যাকেটে ভাল করে মুড়ে ঢুকিয়ে দিয়েছিলেন ফ্রিজে। পচন আটকাতেই ফ্রিজ কিনেছিলেন তিনি।
প্রতি দিন রাত ২টো বাজলেই ফ্রিজ খুলতেন আফতাব। প্রেমিকার দেহের টুকরো একটি একটি করে তুলে নিতেন। তার পর নিকটবর্তী জঙ্গলে গিয়ে টুকরোগুলি ছড়িয়ে দিয়ে আসতেন, প্রতি দিন একটি করে।
পুলিশের কাছে আফতাব জানিয়েছেন, আমেরিকার জনপ্রিয় অপরাধমূলক ওয়েবসিরিজ ‘ডেক্সটার’ দেখে শ্রদ্ধাকে খুনের পরিকল্পনা করেছিলেন তিনি। ১৮ মে খুনের পরিকল্পনা বাস্তবায়িত করেন।
মনোবিজ্ঞানীদের একাংশ দাবি করছেন, আফতাব আদতে সাইকোপ্যাথ। তিনি বিশেষ এক প্রকার মানসিক বিকৃতির শিকার। হয়তো শ্রদ্ধার আগেও আরও খুনের নজির রয়েছে তার। স্বাভাবিক মানসিক পরিস্থিতিতে এমন কাণ্ড ঘটানো সম্ভব নয় বলেই মত বিশেষজ্ঞদের একাংশের।
আফতাবকে ভালবেসে তার সঙ্গে ঘর ছেড়েছিলেন শ্রদ্ধা। এপ্রিল মাসে মুম্বই ছেড়ে তারা দিল্লিতে চলে এসেছিলেন। সেখানে এক মাস কাটতে না কাটতেই এই নারকীয় হত্যাকাণ্ড।
দক্ষিণ দিল্লির অতিরিক্ত ডিসিপি-১ অঙ্কিত চৌহান বলেছেন, মুম্বইতে একটি ‘ডেটিং অ্যাপের’ মাধ্যমে পরিচয় হয়েছিল শ্রদ্ধা এবং আফতাবের। তাঁরা তিন বছর ধরে একত্রবাস করছিলেন এবং দিল্লিতে চলে গিয়েছিলেন। দিল্লিতে চলে যাওয়ার পর পরই, আফতাবকে বিয়ের কথা বলতে থাকেন শ্রদ্ধা। এই নিয়ে দু’জনের মধ্যে প্রায়ই ঝগড়া হত এবং তা নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যেত। এর পর ১৮ মে আফতাব নিজের মেজাজ হারিয়ে শ্রদ্ধাকে শ্বাসরোধ করে খুন করেন।