Breaking News

চারদিকে শুধু কোম্পানী আর কোম্পানী

নারায়ণগঞ্জের সোনারগাঁ উপজেলার পিরোজপুর ইউনিয়নের মানচিত্র থেকে হারিয়ে গেছে অসহায়দের ভূমি। জোরপূর্বক বিভিন্ন শিল্প প্রতিষ্ঠানের মালিকগণ দখলে নিয়েছে শতশত বিঘা ফসলি জমি। যেন “বালুর নিচে কৃষকের স্বপ্ন দাফন আর উপরে ভ্রমণ বিলাসীদের কাঁশফুল বিনোদন।”

নব্বই দশকের পর পিরোজপুর ইউনিয়নের মেঘনাঘাট এলাকা থেকে শুরু করে ইউনিয়নের সর্বত্র একের পর এক বিভিন্ন শিল্পকারখানা সামিট, ওরিয়ন, মেঘনাঘাট পাওয়ার প্লান্ট ও নির্মাণাধীন ইউনিক প্রজেক্টসহ বেশ কয়েকটি বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপন, দখল ও ভরাটের কবলে পড়ে বিলুপ্ত হয়ে গেছে ইরি ও বোরোধানের জমিসহ তিন ফসলি আবাদি কৃষকের অবলম্বন।
বর্তমানে চাষাবাদ করার মত এক খন্ড জমিও নেই পিরোজপুর ইউনিয়নের মানচিত্রে।

মেঘনা নদীবেষ্টিত সোনারগাঁ উপজেলার পিরোজপুর ইউনিয়নের অভ্যন্তরে এক সময় কয়েকটি শাখা নদী, পুরাতন খাল-বিল, ফসলি জমি, মাছ আর জীববৈচিত্র্যে পরিপূর্ণ ছিল পুরো এলাকা। কিন্তু উন্নয়নের নামে অপরিকল্পিত শিল্পায়ন, আধুনিক নগরায়ণ, রাজনৈতিক নেতাদের প্রভাব, শিল্পকারখানায় জড়িত স্থানীয় ব্যবসায়ী-মহল ও সংশ্লিষ্টদের দুর্নীতির মানসিকতা, দালাল ও ভূমিদস্যুদের কবলে হারিয়ে গেছে সব ফসলি জমি।

এছাড়া পিরোজপুর ইউনিয়নে অবস্থিত বিভিন্ন শিল্পকারখানার দূষিত বর্জ্য, শব্দ ও বায়ুদূষণের কবলে পড়েছে পরিবেশ, বিপর্যের মুখে এলাকাবাসী। পিরোজপুর ইউনিয়নের চর-রমজান সোনাউল্লাহ মৌজায় ঝাউচর, প্রতাবেরচর, আষাঢ়িয়ারচর, দুধঘাটা, কোরবানপুর, চর-গোয়ালদী, মঙ্গলেরগাঁও, পিরোজপুর মৌজায় চান্দেরচক, নয়াগাঁও, পিরোজপুর, ছয়হিস্যা ও চরভবনাথপুর মৌজায় কান্দারগাঁও, নাগেরগাঁও, মৃধাকান্দি, জৈনপুর ও ছয়হিস্যাসহ পুরো এলাকায় ছিল বিস্তীর্ণ বিল। যেখানে সারাবছরই নিচু জমি ও ডোবায় পানি জমে থাকত। সেগুলো ভরাট করে তৈরি হচ্ছে বিভিন্ন শিল্পকারখানা, বিদ্যুৎ উৎপাদন কেন্দ্র, বাড়িঘর, দোকানপাটসহ নতুন নতুন স্থাপনা।

বাংলাদেশ পরিবেশ আইন অনুযায়ী, যেকোনো আবাসন বা বড় উন্নয়ন প্রকল্পের জন্য পরিবেশগত প্রভাব সমীক্ষা (ইআইএ) করে এর অনুমোদন নিতে হয়। প্রয়োজন হয় অবস্থানগত ছাড়পত্রের। এসবের পর পরিবেশ ছাড়পত্রের জন্য আবেদন করতে হয়। এসব ছাড়পত্র পেলে তবেই মাটি ভরাটসহ অন্যান্য উন্নয়নমূলক কাজ করতে হয়। কিন্তু সোনারগাঁয়ের পিরোজপুর ইউনিয়নে অবস্থিত শিল্প প্রতিষ্ঠানগুলো এই প্রক্রিয়া অবলম্বন না করে এবং পরিবেশ ছাড়পত্র ছাড়াই বালু ভরাট করে পুরাতন খাল-বিল ও কৃষকদের জমি জোরপূর্বক দখল করে রেখেছে।

রাজধানীর খুব নিকটে মুগল সম্রাট ঈশাখার সোনারগাঁয়ে সবুজ-শ্যামল চাষাবাদ আজ একেবারেই বিলুপ্ত। উপজেলার পিরোজপুর ইউনিয়নের ছয়হিস্যা ও চরভবনাথপুরসহ উপরোক্ত অধিকাংশ এলাকার ফসলি জমি জোরপূর্বক দখলে নিয়ে বালু ভরাট করে রেখেছে নামে বেনামে বিভিন্ন শিল্প প্রতিষ্ঠানের মালিকরা। যেদিকে তাকালে সাদা কাঁশফুলের সমারোহ ছাড়া কিছুই লক্ষ করা যায়না। অনেকের বিঘাবিঘা জমি এখনো বিক্রি করেনি। প্রায় ১ যুগ ধরে কৃষক না পারছে ফসল ঘরে তুলতে, না পেয়েছে জমির ন্যায্য মূল্য! অব্যাহত দখল বাণিজ্য।

ভরাট ও দূষণের কবলে পড়ে পিরোজপুর ইউনিয়নবাসী এখন অস্তিত্ব সঙ্কটে পড়েছে। পাশাপাশি দখল ভরাটের কবলে বর্ষা মৌসুমে জলাধারে পানি জমতে না পারায় ভূ-গর্ভস্থ পানির স্তর ক্রমেই নিচে নেমে যাচ্ছে। শুস্ক মৌসুমে খরার প্রভাবে ফসলি জমি না থাকায়, মৎস্য ও জীববৈচিত্র্য পূর্ণ পিরোজপুর এলাকা স্থায়ীভাবে মরুকরনের দিকে অগ্রসর হচ্ছে। এব্যপারে স্থানীয় পরিবেশবাদী সংগঠন, নাগরিক কমিটি, স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন বিগত সময়ে পরিবেশ রক্ষায় বিভিন্ন কর্মসূচি পালন করলেও কর্তৃপক্ষ তৎপর হয়নি। এ ধারা আর কিছুদিন অব্যাহত থাকলে শুস্ক মৌসুমে এলাকাবাসী সুপেয় পানির সংকটে পড়বে। একই সঙ্গে কৃষি ও জীববৈচিত্র্যে বিরূপ প্রভাব এবং বর্ষা মৌসুমে জলাবদ্ধতার স্থায়ীরূপ নিবে বলে বিশেষজ্ঞদের আশঙ্কা।

চাঁন্দেরচক এলাকার কৃষক নুরুল ইসলাম আক্ষেপ করে জানান, ‘বাপ-দাদার আমল থেকে আমরা যে সব জমিতে ইরি, বোরো ধান চাষ করেছি স্থানীয় কিছু দালাল চক্রের কারনে বাধ্য হয়ে ঐসব জমি বিক্রি করে দিয়েছি। বর্তমানে আমাদের বসতভিটা ছাড়া ধান চাষ করার মত এক টুকরো জমিও আর অবশিষ্ট নেই। বিভিন্ন কৌশলে সব কোম্পানীর লোকেরা জোরপূর্বক কিনে নিয়ে গেছে। চারদিকে শুধু কোম্পানী আর কোম্পানী, ভবিষৎতে আমাদের বসবাস করার মত জায়গা থাকবে কিনা জানিনা।’

কান্দারগাঁও এলাকার কৃষক আনোয়ার হোসেন আফসোস করে বলেন, ‘এখন আর বসতভিটে ছাড়া এক খন্ড জমিও নেই চাষাবাদ করার জন্য। এখানকার একটি বিশাল বিল কোম্পানীর স্থানীয় কিছু দালাল চক্র ও ভূমি দস্যুদের সাহায্যে সাধারণ কৃষকদের চাপে ফেলে কিনে নিয়েছে। আমরা তাদের কাছে অসহায় হয়ে ধানের জমি বিক্রি করতে বাধ্য হয়েছি। অনেকের জমি এখনো কোম্পানির দখলে আছে যা ক্রয় করেনি। এই বিলে ধান চাষ করে সারা বছর আমাদের সংসারে ভাতের যোগান হত। এখন এক খন্ড জমিও নেই ধান চাষ করার মত। বালু ফেলে সব জায়গা ভরাট করে ফেলেছে কোম্পানীর লোকেরা। ভবিষৎতে পরিবার পরিজন নিয়ে কোথায় আশ্রয় নেবো সেটাও জানিনা!’

কামাল হোসেন নামে কান্দারগাঁয়ের আরেক কৃষক বলেন, ‘আমাদের বংশের প্রায় ৩০ বিঘা ফসলী জমি ইউনিক ও মেঘনা গ্রুপ জোরপূর্বক দখলে নিয়ে বালু ভরাট করে রেখেছে। কোম্পানির দালাল ও মালিকদের কাছে আমরা অসহায়। জমি ক্রয় না করে বালু ভরাট করেছে যেখান থেকে আমরা প্রায় একযুগ ধরে এক কেজি ধানও বাড়িতে আনতে পারিনি। অযথা’ই কাঁশফুলের বাগানে পরিনত করে রেখেছে। তিনি বলেন, আমাদের জমিতো দখল করেই রেখেছে পাশাপাশি মেঘনা নদীর তীরেও বালু ভরাট করে তাদের শিল্প প্রতিষ্ঠান তৈরিতে মরিয়া হয়ে গেছে।’

সোনারগাঁয়ের সচেতন মহলের অভিযোগ, এখানকার জমি বিক্রয়মূল্য অন্যান্য নিচু ও চরাঞ্চলের চেয়েও অনেক কম। যেহেতু এখানে অনেক শিল্প প্রতিষ্ঠান রয়েছে সে হিসেবে ফসলি জমির মূল্য আরো বাড়ানো উচিত। সেইসাথে শিল্প প্রতিষ্ঠানগুলো যাদের থেকে জমি ক্রয় করছে তাদের উত্তরাধিকারীদের কর্মসংস্থান দেয়াও জরুরি। কারন অসহায় কৃষকরা জমি বিক্রি করে দিলে তাদের পরিবার পরিজন নিয়ে কি খাবে, কোথায় যাবে?

সোনারগাঁ উপজেলার সহকারী কমিশনার (ভূমি) মোহাম্মদ ইব্রাহিম বলেন, এ বিষয়ে তথ্য উপাত্ত সংগ্রহ করে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেবো।

সোনারগাঁ উপজেলা নির্বাহী অফিসার (ইউএনও) তৌহিদ এলাহী বলেন, কৃষকের জমি জোরপূর্বক দখল করে রাখার বিষয়টি শুনলাম। উপজেলা প্রশাসন বরাবর লিখিত দরখাস্ত করলে অবশ্যই বিষয়টি তদন্ত সাপেক্ষে ব্যবস্থা নেয়া হবে।

Check Also

কন্যার ছিন্নভিন্ন দেহ কুড়াচ্ছিলেন মা

অনেক সাধনা। দীর্ঘ প্রতীক্ষা। সংসার পাতার আট বছর পর গিয়াস-রাবেয়া দম্পতির ঘরে জ্যোতি ছড়ায় রায়সা …

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *