এক কেজি গাঁজাসহ গ্রেপ্তারের মামলায় দুই আসামি দোষ স্বীকারের পর তাদের সাজা না দিয়ে তিন শর্তে প্রবেশনে মুক্তি দিয়েছে চট্টগ্রামের একটি আদালত।
দুই আসামিকে যে তিন শর্তে মুক্তি দেওয়া হয়েছে, তা হচ্ছে – এক বছর পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ পড়া, দুটি বাংলা কোরআন শরিফ এতিমখানায় দান করা এবং আগামী এক বছর মাদক সংক্রান্ত কোনো ঘটনায় সম্পৃক্ত বা গ্রেপ্তার না হওয়া।
চট্টগ্রাম মহানগর হাকিম কাজী শরীফুল ইসলাম সোমবার মামলার অভিযোগ গঠনের ধার্য দিনে এই আদেশ দেন।রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবী জানিয়েছেন, আদালত আসামিদের বক্তব্য যাচাই করে সাজার পরিবর্তে প্রবেশন দেয়।আসামি পক্ষের আইনজীবী এ আদেশে সন্তুষ্টি প্রকাশ করেছেন।
তবে চট্টগ্রাম আদালতের জ্যেষ্ঠ এক আইনজীবী বলছেন, মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ আইনের মামলায় দোষ স্বীকার করলে পেনাল কোড অনুসারে শাস্তি হিসেবে কারাদণ্ড ও জরিমানার বিধান রয়েছে। সেক্ষেত্রে এ ধরনের কোনো শর্ত আরোপের সুযোগ নেই।
মামলার এজাহারের তথ্য অনুযায়ী, চলতি বছরের ২২ মে নগরীর বন্দর থানার পোর্ট কলোনি ১ নম্বর রোড সংলগ্ন বন্দর নতুন মার্কেটের একটি চা দোকান থেকে মোহাম্মদ হোসেন (৪২) ও আব্দুর রহিম (৩০) নামের দুজনকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ।
তাদের কাছ থেকে ১ কেজি গাঁজা উদ্ধারের কথা জানিয়ে বন্দর থানার এসআই মাসুদুর রহমান বাদী হয়ে গ্রেপ্তার দুজনকে আসামি করে মামলা করেন। তদন্ত শেষে গত ২৯ জুন অভিযোগপত্র জমা দেয় পুলিশ।
গ্রেপ্তারের পর সপ্তাহখানেক কারাগারে থাকা দুই আসামি এরপর থেকে জামিনে ছিলেন। সোমবার অভিযোগ গঠনের ধার্য দিনে তারা আদালতে উপস্থিত হন।
আসামিপক্ষের আইনজীবী সঞ্জয় দে বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “দুই আসামির মধ্যে মোহাম্মদ হোসেন গাড়িচালক এবং আব্দুর রহিম মিস্ত্রি। আব্দুর রহিম কিডনির রোগে আক্রান্ত।
“আমরা আসামিদের অভিযোগ থেকে অব্যাহতির আবেদন করেছিলাম। তারা আদালতে দোষ স্বীকার করেছেন। তাদের আগের কোনো মামলা না থাকায় আদালত সাজা না দিয়ে এক বছরের প্রবেশন দিয়েছেন।”
আইনজীবী সঞ্জয় বলেন, “আদালত প্রবেশনের শর্ত হিসেবে দুটি বাংলা কোরআন শরিফ দুটি মাদ্রাসায় দিতে এবং প্রতিদিন পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ পড়তে বলেছেন। এছাড়া এই সময়ের মধ্যে তারা কোনো মাদক গ্রহণ, পরিবহন ও বিক্রয় বা মাদক সংক্রান্ত কোনো বিষয়ে সম্পৃক্ত হতে বা কোনো মাদকের মামলায় গ্রেপ্তার হতে পারবেন না।”
এসব শর্ত পর্যবেক্ষণে কোনো প্রবেশন অফিসার নিয়োগ দেওয়া হয়েছে কি না- জানতে চাইলে আইনজীবী সঞ্জয় ‘না’ সূচক জবাব দেন।
মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ আইন, ২০১৮ এর ৩৬(১-ক) ধারায় এই মামলায় দোষী সাব্যস্ত হলে সর্বনিম্ন ১ বছর থেকে সর্বোচ্চ ৫ বছরের সাজা ও অর্থদণ্ডের বিধান আছে।
ওই আদালতের রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবী এপিপি মোহাম্মদ রায়হান উদ্দিন রনি বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “দুই আসামি আদালতে দোষ স্বীকার করেছেন। আদালত নথিপত্র পর্যালোচনা করেছেন। আসামিদের বক্তব্য শুনেছেন। তারপর তাদের নামাজ পড়া, কোরআন শরীফ দান এবং এই সময়ে কোনো মাদক সংক্রান্ত ঘটনায় সম্পৃক্ত না হওয়ার শর্তে প্রবেশনের আদেশ দিয়েছেন।”
এই আদেশের বিষয়ে চট্টগ্রাম আদালতের জ্যেষ্ঠ আইনজীবী আখতার কবীর চৌধুরী বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমের জিজ্ঞাসায় বলেন, “দোষ স্বীকার করলে আইনের সংশ্লিষ্ট ধারায় সর্বোচ্চ যে সাজা, কমপক্ষে এর এক-চতুর্থাংশের সমান সাজা দিতে হয়। মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ আইনের মামলায় পেনাল কোড (দণ্ডবিধি), ফৌজদারি কার্যবিধি, সাক্ষ্য প্রমাণ ও সাক্ষ্য আইন অনুসরণ করে আদালত।
“এক্ষেত্রে যে শর্তের কথা বলা হয়েছে, তা সংশ্লিষ্ট আইন সমর্থন করে না। মাদকদ্রব্য নিয়্ন্ত্রণ আইনের মামলায় এ ধরনের কোনো প্রবেশন দেওয়ার সুযোগ আছে বলে আমার জানা নেই।”
আখতার কবীর বলেন, “বাংলাদেশে বিয়ে, সন্তানের অধিকার, ডিভোর্স, সম্পত্তির অধিকার এসব পারসোনাল ল’র অন্তর্ভুক্ত বিষয়ে ধর্মীয় বিধান অনুসরণ করা হয়।
“কিন্তু এর বাইরে অন্য সকল রাষ্ট্রীয় আইন আইনের বিধি-বিধান অনুসারে পরিচালিত হয়। যেহেতু এই আসামিরা আদালতে দোষ স্বীকার করেছে, তাহলে তাদের শাস্তি দেওয়াই পেনাল কোডের বিধান।”
দোষ স্বীকারের পর শর্তযুক্ত মুক্তি ‘দুঃখজনক দৃষ্টান্ত’ মন্তব্য করে প্রবীণ আইনজীবী আখতার কবীর বলেন, “এটা সর্বত্র ভুল মেসেজ দিতে পারে। সামাজিকভাবে আমরা পিছিয়ে যাওয়ার যেসব লক্ষণ দেখতে পাচ্ছি এটিও তার অনুষঙ্গ কিনা এমন প্রশ্নও উঠতে পারে।
“এটা কাজীর দরবার বা সালিশ নয়, বিচার অঙ্গন। যা কিছু আদালতের আইনগত সীমার মধ্যে আছে, কেবল তাই করা উচিৎ।”