মানবপাচার ও মানি লন্ডারিংয়ের অভিযোগে কুয়েতে গ্রেপ্তার হয়েছেন লক্ষ্মীপুর-২ আসনের সংসদ সদস্য কাজী শহীদ ইসলাম পাপুল। তিনি বাংলাদেশ থেকে কুয়েতে গিয়েছিলেন শ্রমিক হিসেবে, আজ তিনি সেই দেশে দুটি কম্পানির ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি), নিজ দেশে ব্যাংকের পরিচালকসহ একাধিক ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানের কর্ণধার। আলিশান বাড়ি-গাড়িসহ কয়েক হাজার কোটি টাকার মালিক। শুধু কি সম্পদশালী? কোনো দলের রাজনীতির সঙ্গে জড়িত না থাকলেও অনেকটা আকস্মিকভাবে স্বামী-স্ত্রী দুজনই এখন সংসদ সদস্য। আঙুল ফুলে কলাগাছ বনে যাওয়া এই ব্যক্তির বিরুদ্ধে মানবপাচারের মাধ্যমে প্রায় দেড় হাজার কোটি টাকা হাতিয়ে নেওয়ার অভিযোগে প্রতিবেদন ছাপা হয়েছে কুয়েতের গণমাধ্যমে।
গত শনিবার রাতে কুয়েতের মুশরেফ আবাসিক এলাকা থেকে দেশটির অপরাধ তদন্ত বিভাগ (সিআইডি) তাঁকে গ্রেপ্তার করেছে। তাঁর বিরুদ্ধে দেশটিতে মানব পাচার ও মানি লন্ডারিংয়ের অভিযোগ রয়েছে। গ্রেপ্তারের পর এমপি পাপুলকে আদালতে হাজির করলে জামিন আবেদন নাকচ করে তাঁকে কারাগারে পাঠিয়ে দেয়া হয়েছে।
কুয়েতের বিভিন্ন গণমাধ্যমে প্রকাশিত খবর এবং প্রবাসীদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, ‘মানব ও অর্থ পাচারসহ বিভিন্ন জালিয়াতিতে জড়িত থাকার অভিযোগ রয়েছে, এমন কয়েক শ ব্যক্তির তালিকা করেছে কুয়েত সরকার। সেই তালিকা ধরেই সম্প্রতি বিতর্কিত শতাধিক ব্যক্তিকে গ্রেপ্তার করে দেশটির গোয়েন্দা বিভাগ। সেই অভিযানেই গ্রেপ্তার হন এমপি পাপুল।
কুয়েতে নিযুক্ত বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত এস এম আবুল কালাম এ ব্যাপারে গণমাধ্যমকে বলেন, ‘সংসদ সদস্য মোহাম্মদ শহিদ ইসলাম পাপুলকে কুয়েতের সিআইডি পুলিশ গ্রেপ্তার করেছে বলে আমরা শুনেছি। তবে এখনো অফিশিয়ালি আমাদের জানানো হয়নি। আমরা বিষয়টি বিস্তারিত জানার চেষ্টা করছি।’
গত ১৩ ফেব্রুয়ারি মধ্যপ্রাচ্যের প্রভাবশালী দৈনিক আরব টাইমস, আরবি দৈনিক আল কাবাস, কুয়েতি টাইমসসহ কয়েকটি দৈনিকে প্রকাশিত প্রতিবেদনে বাংলাদেশি এই এমপির বিরুদ্ধে মানবপাচারে জড়িত থাকার তথ্য উঠে আসে। কুয়েত পুলিশের বরাত দিয়ে আল কাবাসের প্রতিবেদনে বলা হয়, চক্রটি ২০ হাজারের বেশি বাংলাদেশিকে কুয়েতে নিয়েছিল। এমপি পাপুল তাদের কাছ থেকে জনপ্রতি নিয়েছেন পাঁচ থেকে ছয় লাখ টাকা। এভাবে তিনি পাঁচ কোটি কুয়েতি দিনার পকেটে পোরেন, বাংলাদেশি মুদ্রায় যার পরিমাণ প্রায় এক হাজার ৪০০ কোটি টাকা।
জানা গেছে, পাপুল ১৯৯২ সালে শ্রমিক হিসেবে কুয়েতে যান বড় ভাই বিএনপি নেতা কাজী মঞ্জুরুল আলমের হাত ধরে। সেই ব্যক্তিই আজ দেশে দুটি কম্পানির ব্যবস্থাপনা পরিচালকসহ একাধিক ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানের কর্ণধার। কুয়েতেও রয়েছে তাঁর একাধিক প্রতিষ্ঠান। আলিশান বাড়ি-গাড়িসহ কয়েক হাজার কোটি টাকার মালিক তিনি।
পাপুলের প্রভাব-প্রতিপত্তি শুধু বিত্তে থেমে থাকেনি। কোনো রাজনৈতিক দলের সঙ্গে জড়িত না থেকেও একাদশ জাতীয় নির্বাচনে অনেকটা আকস্মিকভাবে স্বামী-স্ত্রী দুজনই হয়েছেন সংসদ সদস্য। নিজে স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে নির্বাচিত হন। আর স্ত্রী সেলিনা ইসলাম কুমিল্লা থেকে সংরক্ষিত আসনের সংসদ সদস্য হয়েছেন।
পাপুলের বিরুদ্ধে অবৈধভাবে সম্পদ অর্জনের অভিযোগে দুর্নীতি দমন কমিশনে (দুদক) অনুসন্ধানও চলছে। দুদকের পরিচালক মোহাম্মদ আব্দুল আউয়ালের তত্ত্বাবধানে এই অনুসন্ধান কার্যক্রম চলছে। দুদকে আসা অভিযোগপত্রে এমপি কাজী শহিদের বিরুদ্ধে কমিশন খেয়ে ব্যাংকঋণ বরাদ্দসহ বিভিন্ন দুর্নীতির মাধ্যমে শত শত কোটি টাকার অবৈধ সম্পদ অর্জন ও অর্থপাচারে জড়িত থাকার তথ্য পাওয়ার উল্লেখ রয়েছে।
লক্ষ্মীপুরে আওয়ামী লীগ নেতাকর্মীদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, ঢাকা ও চট্টগ্রামে বেড়ে ওঠা পাপুল ২০১৬ সালে লক্ষ্মীপুরের রায়পুরে আসেন। একাদশ সংসদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগ জোট শরিক জাতীয় পার্টির জেলা সভাপতি মোহাম্মদ নোমানকে লক্ষ্মীপুর-২ আসনে মনোনয়ন দেয়। আর পাপুল স্বতন্ত্র প্রার্থী হন। নির্বাচনের এক সপ্তাহ আগে মোহাম্মদ নোমান নাটকীয়ভাবে গাঢাকা দেন। সে সময় অভিযোগ ওঠে, পাঁচ কোটি টাকার বিনিময়ে নোমানকে ভোটের মাঠ থেকে সরিয়ে দেন পাপুল। পরে ভোটে জিতে এমপি হয়ে যান পাপুল। পরবর্তী সময়ে স্ত্রী সেলিনা ইসলামের জন্যও বাগিয়ে নেন কুমিল্লার সংরক্ষিত আসনের এমপির পদ। সেলিনা কুমিল্লার মেঘনা উপজেলার বাসিন্দা।
অভিযোগ রয়েছে, পাপুল এমপি ব্যবসার আড়ালে প্রায় দেড় হাজার কোটি টাকা বিদেশে পাচার করেছেন। এ ছাড়া ২০১৬ সালে দেশ থেকে ২৮০ কোটি টাকা হুন্ডি ও বিভিন্ন ব্যক্তির ব্যাংক হিসাবের মাধ্যমে পাচার করেন। বাকি টাকা তাঁর শ্যালিকা জেসমিন প্রধান এবং জেডডাব্লিউ লীলাবালি নামক প্রতিষ্ঠানের হিসাবে জমা করেন।
গুলশান-১ নম্বরের ১৬ নম্বর সড়কে গাউসিয়া ডেভেলপমেন্টের প্রকল্পে মেয়ে ও স্ত্রীর নামে দুটি ফ্ল্যাট, গুলশান-২ নম্বরে পিংক সিটির পেছনে গাউসিয়া ইসলামিয়া প্রকল্পে স্ত্রীর নামে ৯ হাজার বর্গফুটের ফ্ল্যাট, স্ত্রী ও নিজের নামে লক্ষ্মীপুরের রায়পুরসহ বিভিন্ন স্থানে ৯১ কোটি টাকার সম্পদ রয়েছে পাপুলের। এ ছাড়া স্ত্রীর নামে ৫০ কোটি টাকার ওয়েজ আর্নার্স বন্ড ও মেয়ের নামে ২০ কোটি টাকার বন্ড রয়েছে। একটি ব্যাংকে নিজ নামে ৪০ কোটি, মেয়ের নামে ১০ কোটি ও স্ত্রীর নামে ২০ কোটি টাকার স্থায়ী আমানত রয়েছে। রাজধানীর এক আবাসিক এলাকায় স্ত্রীর নামে রয়েছে ছয় তলাবিশিষ্ট একটি বাড়ি। একাত্তরে মানবতাবিরোধী অপরাধের দায়ে দণ্ডপ্রাপ্ত জামায়াত নেতা কাসেম আলীর সঙ্গে তাঁর ছিল বিপুল অঙ্কের টাকার ব্যবসা। মীর কাসেম আলীর বিপুল অর্থও তিনি আত্মসাৎ করেন বলে অভিযোগ রয়েছে।