কুড়িগ্রামের প্রত্যন্ত উপজে’লা ভুরুঙ্গামা’রী। এ উপজে’লার সরকারি নেহাল উদ্দিন পাইলট বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক লুৎফর রহমান। তার বি’রু’দ্ধে দিনাজপুর শিক্ষাবোর্ডের এসএসসি পরীক্ষার চার বিষয়ের প্রশ্নফাঁ’সের অ’ভিযোগ উঠেছে। কেন্দ্রসচিবের দায়িত্বে থেকে তিনি থা’নার লকার থেকে নিয়ম ভে’ঙে প্রশ্ন বের করেছেন। শিক্ষা মন্ত্রণালয় প্রাথমিকভাবে এর প্রমাণও পেয়েছে। তার এমন কা’ণ্ডে চরম বিব্রত মন্ত্রণালয়। ক্ষুব্ধ পরীক্ষার্থী ও অ’ভিভাবকরাও। পরীক্ষা পিছিয়ে যাওয়ায় খা’রা’প ফল করার শ’ঙ্কায় পড়েছেন তারা।
শিক্ষা মন্ত্রণালয় বলছে, উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে প্রশ্নফাঁ’সের ঘটনা ঘটানো হয়েছে কি না, তা খতিয়ে দেখা হচ্ছে। এ ঘটনায় তিনজনকে গ্রে’প্তা’র করা হয়েছে। জ’ড়ি’ত আরও একজনকে খুঁজছে পু’লিশ। একই সঙ্গে নতুন করে প্রশ্নপত্র ছাপিয়ে দ্রুত স্থগিত চার বিষয়ের পরীক্ষা নেওয়া হবে।
তবে ওই প্রশ্নপত্র ছড়িয়ে দেওয়া হয়নি দাবি করে মন্ত্রণালয় বলছে, এটিকে প্রশ্নফাঁ’স বলা যাবে কি না, সেটিও চিন্তা-ভাবনা করা প্রয়োজন। কেন্দ্রসচিব নিকটাত্মীয়কে সহযোগিতা করতেই এমন ঘটনা ঘটাতে পারেন। এখানে মূলত ক্ষমতার অ’পব্যবহার করা হয়েছে বলে মনে করছে মন্ত্রণালয়।শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা বিভাগের সচিব মো. আবু বকর ছিদ্দীক বুধবার (২১ সেপ্টেম্বর) জাগো নিউজকে এসব তথ্য জানিয়েছেন। তিনি বলেন, ‘প্রশ্ন আনা-নেওয়া করতে কাউকে না কাউকে তো দায়িত্ব দিতেই হবে। তারা যদি এ ধরনের জঘন্য কাজ করেন, তবে তা ঠেকানো কঠিন। আম’রা দ্রুত নতুন প্রশ্ন ছাপিয়ে স্থগিত পরীক্ষাগুলো নেবো।’
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, মঙ্গলবার পরীক্ষা শেষে প্রশ্নের খাম গণনা করে একটি খাম কম পাওয়া যায়। সেটি খুঁজতে গিয়ে মূলত প্রশ্নফাঁ’সের বিষয়টি উঠে আসে। গণিত, পদার্থবিজ্ঞান, কৃষিবিজ্ঞান ও রসায়ন পরীক্ষার প্রশ্নফাঁ’স হয়। বিষয়টি নিয়ে মঙ্গলবার (২০ সেপ্টেম্বর) সকালেই পু’লিশের পক্ষ থেকে একটি প্রতিবেদন দেওয়া হয়। তবে শিক্ষা মন্ত্রণালয় প্রথমে তা আমলে নেয়নি। পরে ঘটনা জানাজানির পর লকার থেকে প্রশ্ন আনা-নেওয়ার দায়িত্বে থাকা কয়েকজন মাঠ কর্মক’র্তাকে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না।
কেন্দ্রসচিবসহ তিন শিক্ষককে গ্রে’প্তা’র করেছে পু’লিশ। গ্রে’প্তা’ররা হলেন নেহাল উদ্দিন পাইলট বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক ও কেন্দ্রসচিব লুৎফর রহমান, একই বিদ্যালয়ের ইংরেজি বিষয়ের সহকারী শিক্ষক রাসেল ও ই’স’লা’ম শিক্ষা বিষয়ের সহকারী শিক্ষক জোবায়ের।
তাদের বি’রু’দ্ধে মা’ম’লা হয়েছে। ওই মা’ম’লায় গ্রে’প্তা’র দেখিয়ে তাদের আ’দা’লতের মাধ্যমে জে’লহাজতে পাঠানো হয়। এছাড়া ঘটনায় জ’ড়ি’ত স’ন্দেহে নেহাল পাইলট বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষক মো. হামিদুর রহমান ও সোহেলকে থা’নায় ডেকে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়।
কেন্দ্রসচিব জঘন্য কাজে জড়িয়েছেন
অন্যবারের চেয়ে এবারের প্রশ্নফাঁ’সের ঘটনা একেবারেই ভিন্ন বলে উল্লেখ করেছেন শিক্ষাসচিব আবু বকর ছিদ্দীক।তিনি বলেন, ‘কেন্দ্রসচিব এক বিষয়ের প্রশ্ন আনতে গিয়ে আরও তিন বিষয়ের প্রশ্নপত্রের প্যাকেট খুলে নিয়ে যান। যে পরীক্ষাগুলো পরে হওয়ার কথা। এটি শনাক্ত করা হয়েছে। আগে প্রশ্ন হয়তো বিজি প্রেস বা অন্য কোথাও থেকে ফাঁ’স হতো। এখন সেটি বন্ধ হয়েছে। অথচ একজন প্রধান শিক্ষক যিনি পরীক্ষাকেন্দ্রে সচিবের দায়িত্বে থাকেন, তার মাধ্যমে এমন জঘন্য কাজ সংঘটিত হওয়ায় আম’রা চরম বিব্রত।’
‘কোন উদ্দেশ্যে কেন্দ্রসচিব প্রশ্নফাঁ’স করেছেন, সেটা আইনশৃঙ্খলা বাহিনী খতিয়ে দেখছে। বর্তমানে তিনিসহ (কেন্দ্রসচিব) তিনজনকে পু’লিশ গ্রে’প্তা’র করেছে। কেন্দ্রসচিবের সঙ্গে থাকা আরও একজন পলাতক। তাকেও পু’লিশ খুঁজছে’ যোগ করেন মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা বিভাগের এ সচিব।
পু’লিশের প্রতিবেদনে গুরুত্ব দেয়নি মন্ত্রণালয়
লকার থেকে প্রশ্নপত্র বের করার পরই ফাঁ’স হওয়ার বিষয়ে প্রতিবেদন দিলেও তাতে গুরুত্ব দেয়নি শিক্ষা মন্ত্রণালয়। পাশাপাশি যে শিক্ষক লকার থেকে প্রশ্নগুলো বের করেছেন, তিনি ছড়িয়ে দেওয়ার উদ্দেশ্যেও করেননি বলে মনে করছেন সচিব আবু বকর ছিদ্দীক।এ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘মঙ্গলবার (২০ সেপ্টেম্বর) সকালে পু’লিশের পক্ষ থেকে আমাদের একটি রিপোর্ট দেওয়া হয়। তবে প্রথম আম’রা তাতে খুব বেশি গুরুত্ব দেইনি। সেখানে দায়িত্বরত কাউকে না পাওয়ায় কুড়িগ্রামের পু’লিশ সুপার, জে’লা প্রশাসক ও দিনাজপুর বোর্ডের চেয়ারম্যানকে ঘটনাস্থলে পাঠানো হয়। তারা চার ঘণ্টা সেখানে অবস্থান করেন, সবাইকে জিজ্ঞাসাবাদও করেছেন।’
সচিব আরও বলেন, ‘থা’নায় থাকা প্রশ্নপত্রের স্ট’ক যাচাই করে চার বিষয়ের কিছু প্রশ্ন শর্ট (ঘাটতি) পেয়েছেন। কয়েকটি প্রশ্নের প্যাকেট খোলা পান। বিষয়টি আমাদের জানালে জরুরি সভা করে আম’রা সেসব পরীক্ষা বাতিল করেছি। এখন নতুন করে প্রশ্ন ছাপিয়ে সেসব পরীক্ষা নেওয়া হবে।’আবু বকর ছিদ্দীক বলেন, ‘ফাঁ’স হওয়া প্রশ্নপত্র থা’না হেফাজতে রাখা হয়। দায়িত্বরত শিক্ষক-কর্মক’র্তারা যদি আনা-নেওয়ার সময় অসৎ কাজ করেন, এটাকে রোধ করা সম্ভব নয়। তাদের বি’রু’দ্ধে শক্ত আইনি পদক্ষেপ ছাড়া এটা ঠেকানো যাবে না।’
তিনি বলেন, ‘কেন্দ্রসচিব থা’নার লকার থেকে প্রশ্ন আনার সময় তার সঙ্গে একজন টেক অফিসার, জে’লা/উপজে’লা পর্যায়ের শিক্ষা অফিসার থাকেন। তারা লকারে প্রবেশে অনুমোদনপত্র নিয়ে যান। সেখানে ঢুকে তারা কী করছেন, তা পু’লিশের দেখার বিষয় নয়। তারা এক প্যাকেট প্রশ্ন আনতে গিয়ে আরও তিন প্যাকেট খুলে বিজ্ঞান বিভাগের বিভিন্ন বিষয়ের প্রশ্ন নিয়ে চলে এসেছেন।’
আত্মীয়কে দিতে প্রশ্ন বের করেন কেন্দ্রসচিব!
মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা বিভাগের সচিব বলেন, প্রশ্নগুলো এনে কেন্দ্রসচিব মাঠেঘাটে কোথাও ছড়িয়ে দেননি। নিজের কাছে রেখে দিয়েছেন। আম’রা চারটি প্রশ্নের প্যাকেট খোলা পেয়েছি। তার মানে বেঝা যাচ্ছে, কেন্দ্রসচিব তার নিকটাত্মীয়কে সহযোগিতা করতে এমন কাজ করেছেন।’এ ঘটনাকে প্রশ্নফাঁ’স বলা যাবে কি না, তাও ভেবে দেখতে হবে উল্লেখ করে আবু বকর ছিদ্দীক বলেন, ‘প্রশ্ন ছড়িয়ে দেওয়ার জন্য তিনি (কেন্দ্রসচিব) এটা করেননি। অন্যবারের প্রশ্নফাঁ’সের সঙ্গে এবারের ঘটনার স্পষ্ট পার্থক্য রয়েছে। এটিকে প্রশ্নফাঁ’স বলা যাবে কি না, সেটিও চিন্তা-ভাবনা করা প্রয়োজন। এখানে মূলত ক্ষমতার অ’পব্যবহার বলে মনে করছি।’
ভুল করলেই কঠোর ব্যবস্থা
পরীক্ষার নিয়ম ও নির্দেশনা যারা মানছেন না তাদের বি’রু’দ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে বলেও জানান এ সচিব।আবু বকর ছিদ্দীক বলেন, যশোর শিক্ষাবোর্ডে বাংলা দ্বিতীয়পত্রের এমসিকিউ পরীক্ষার প্রশ্ন অন্য শিক্ষাবোর্ডের সঙ্গে বিতরণে ওলট-পালট হওয়ায় তা বাতিল করা হয়। নতুনভাবে ওই পরীক্ষা নেওয়ার সিদ্ধান্ত হয়েছে। ব্রাহ্মণবাড়িয়ার নবীনগরে এক সেটের বদলে অন্য সেটের প্রশ্ন বিতরণের ঘটনা ঘটে। দায়িত্বে অবহেলার কারণে এ ধরনের ভুল হয়েছে। সেখানে দুই সেট প্রশ্ন ছিল। কেন্দ্রসচিব যে সেটের প্রশ্ন বিতরণে মেসেজ পেয়েছেন, তখন অন্য সেটের পরীক্ষা নেওয়ার কারণ থাকতে পারে না। যারা এ ধরনের ভুল করেছেন, তাদের বি’রু’দ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে।
আরেক প্রশ্নের উত্তরে সচিব বলেন, ত’দ’ন্ত করার পর সঠিক ঘটনা যানা যাবে। যাদের অ’প’রা’ধ প্রমাণিত হবে, তাদের বি’রু’দ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া হবে। কাউকে না কাউকে দিয়ে তো কাজ করতে হবে। এখন সে যদি এ ধরনের অন্যায় করে, তা রোধ করা কঠিন। ভবিষ্যতে আম’রা আরও কী কী করতে পারি, তা ভেবে দেখতে হবে।
‘বিজি প্রেস থেকে একটি বিষয়ের প্রশ্ন ছাপাতে চারদিন লাগে। দ্রুত এসব প্রশ্ন ছাপিয়ে পরীক্ষা নেওয়া হবে। সারাদেশে ২৯ হাজার শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে পরীক্ষা হচ্ছে। তিন হাজার ৭৯০টি কেন্দ্রে দেশে এবং বিদেশে ৯ কেন্দ্রে পরীক্ষা হচ্ছে। একটি কেন্দ্রেও যেন এ ধরনের ঘটনা না ঘটে, সেজন্য কী করা যায়, তা আমাদের চিন্তা-ভাবনা করে অবশ্যই দেখতে হবে’ বলেও উল্লেখ করেন মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা বিভাগের এ সচিব।
প্রশ্নফাঁ’সে যে চার বিষয়ের পরীক্ষা স্থগিত
প্রশ্নফাঁ’সের অ’ভিযোগ খতিয়ে দেখে প্রাথমিকভাবে সত্যতা পাওয়ায় দিনাজপুর শিক্ষাবোর্ডের চার বিষয়ের পরীক্ষা স্থগিত করা হয়েছে। বোর্ডের চেয়ারম্যান অধ্যাপক মো. কা’ম’রুল ই’স’লা’মের সই করা জরুরি বি’জ্ঞ’প্তিতে এ তথ্য জানানো হয়।ওই চার বিষয় হলো- গণিত, পদার্থবিজ্ঞান, কৃষিবিজ্ঞান ও রসায়ন। এর মধ্যে গণিত বিষয়ের পরীক্ষা হওয়ার কথা ছিল ২২ সেপ্টেম্বর বৃহস্পতিবার। এছাড়া ২৪ সেপ্টেম্বর পদার্থবিজ্ঞান, ২৫ সেপ্টেম্বর কৃষিবিজ্ঞান ও ২৬ সেপ্টেম্বর রসায়ন বিষয়ের পরীক্ষার হওয়ার কথা ছিল।